সর্বাত্মক যুদ্ধের মুখে ইরান-ইসরায়েল

জাহাঙ্গীর সুর
১৬ জুন ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
সর্বাত্মক যুদ্ধের মুখে ইরান-ইসরায়েল

‘নেই’ আর ‘নব্বই’ কি একই কথা? ইরানের কোনো পারমাণবিক অস্ত্র নেই। ইসরায়েলের আছে নব্বইটি। তাহলে তেলআভিভের ভয় কীসে? তেহরান যে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রকল্প বাড়িয়ে চলছে, তা দিয়ে যদি সত্যি সত্যি আধুনিক পারমাণবিক অস্ত্র বানিয়ে ফেলে, তা হলে তো রক্ষা নেই ইহুদি রাষ্ট্রের। সেহেতু, এই পথ থেকে ইরানকে নিবৃত্ত রাখা চাই। জোরপূর্বক একপেশে পারমাণবিক চুক্তিতে তেহরানকে বাধ্য করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। ‘কথা কানে তুলছে না’ অভিযোগ তুলে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সার্বভৌম দেশে সামরিক হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল।

ওয়াশিংটন থেকে এবং পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর পাতায় পাতায় বলা হচ্ছে, এই হামলায় আমেরিকা জড়িত নয়, কিন্তু ধারণা করা হচ্ছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অলিখিত অনুমোদন বা নীরব সমর্থনের সাপেক্ষেই যুদ্ধবাদী ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই যুদ্ধ শুরু করেছেন। এখন ইরান তার শক্তির ভা-ার থেকে যথাসম্ভব শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করছে।

কারও ভূমি বা আকাশ ব্যবহার না করে (সেই সুযোগ তেহরান পায়নি), দেড় হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ‘অজেয়’ বলে খ্যাত আয়রন ডোম ভেদ করে ধসিয়ে দিয়েছে বেশ কিছু ইসরায়েলি স্থাপনা। এসব ধ্বংসস্তূপের ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর অনেকে গাজার ধ্বংসচিত্রের সঙ্গে তুলনা করছেন। ইরানি হামলায় অন্তত ১৩ ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন। একে ‘অত্যন্ত বেদনায়ক ও কঠিন’ বাস্তবতা উল্লেখ করে ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজোগ সামাজিক মাধ্যম এক্সে এক পোস্টে বলেছেন, ‘ইরানের এই অপরাধমূলক হামলায় শিশু-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ইহুদি ও আরব, ইসরায়েলি নাগরিক ও নতুন অভিবাসী নিহত ও আহত হয়েছেন।’

এইটুকু ‘পরাজয়’ও ইসরায়েল মেনে নিতে পারছে না। মরিয়া হয়ে উঠেছে ইরানের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীকে উৎখাতে। যেমন তারা এরই মধ্যে ঘোষণা করেছে, ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি তাদের হামলার ‘সীমার বাইরে নন’ মোটেও। এর আগে কদিনের হামলায় ইরান এরই মধ্যে সেনাপ্রধান ও ইসলামিক বিপ্লবী বাহিনীর প্রধানসহ শীর্ষ সামরিক নেতৃত্বকে হারিয়েছে। শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীও জনা ছয়েক নিহত হয়েছেন।

চুক্তিতে রাজি হলে যে কোনো সময় যুদ্ধ থামিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতা করতে আগ্রহী বলে জানিয়ে রেখেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। অথচ এই ডোনাল্ড ট্রাম্পই তার প্রথম মেয়াদে ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি থেকে একতরফা যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়েছিলেন।

সর্বাত্মক যুদ্ধ চাই না- এ কথা ইরানের তরফেও বলা হচ্ছে বারবার। কিন্তু গতকাল দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি জোরালো কণ্ঠে বলেছেন, সার্বভৌমত্বের ওপর শত্রুর যে কোনো আগ্রাসন থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রতিরোধ চালিয়ে যাবে ইরান। ইসরায়েল যে মুহূর্তে আগ্রাসন বন্ধ করবে, ইরানও প্রতিরোধ অভিযানের লাগাম টেনে ধরবে।

কিন্তু থামছে না কোনো পক্ষই। গতকাল রবিবার টানা তৃতীয় দিনের মতো দুই দেশই পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। সামরিক স্থাপনা, গবেষণাগার, তেলক্ষেত্র ও বেসামরিক স্থাপনায় হামলা চলছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, ইরান থেকে এ দিন ইসরায়েল লক্ষ্য করে আবার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে নতুন করে হামলা চালানোর কথা বলা হয়েছে। নেতানিয়াহু ধ্বংসস্তূপ পরিদর্শন শেষে আবার হুমকি দিয়েছেন, তেহরানকে জ¦ালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া হবে। তিনি ইরানি জনতাকে তাদের ‘উন্মাদ’ শাসকগোষ্ঠীকে উৎখাতের উসকানি দিয়েছেন।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী জানিয়েছে, ইরানেও আরও হামলা চলছে। মুখপাত্র এফি ডেফরিন বলেন, ‘আমরা এক মুহূর্তের জন্যও হামলা বন্ধ করছি না। প্রতিক্ষণ তেহরানে আমরা বিভিন্ন নতুন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়ে যাচ্ছি।’ তেহরানে অন্তত ৮০টি লক্ষ্যবস্তুতে গতকাল হামলা চালানো হয়েছে। ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’-এর অংশ হিসেবে তিন দিনে ইরানের ৭২০টির মতো সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করার দাবি করেছে ইসরায়েল। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ ইরানকে হুশিয়ার করে বলেছেন, তাদের ‘পারমাণবিক সক্ষমতা ও অস্ত্রব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া হবে।’ ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে ইঙ্গিত করে কাৎজ বলেন, ‘ইরানের স্বৈরশাসক নিজের শাসন টিকিয়ে রাখতে তেহরানকে বৈরুত বানিয়ে ফেলেছেন এবং তেহরানের জনগণকে জিম্মি করে রেখেছেন।’ এরই মধ্যে ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে হামলা করেছে ইসরায়েল।

এই যুদ্ধে ইসরায়েলের সাফল্যের পেছনে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ অন্যতম প্রধান ভূমিকা রাখছে। গতকাল ইরান দাবি করেছে, তারা মোসাদের দুই গুপ্তচরকে আটক করেছে। এই দুই ব্যক্তি আলবোর্জ প্রদেশে বিস্ফোরক ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বানানোর সময় ধরা পড়েছেন। ইসরায়েল সরকার কিংবা পশ্চিমা গণমাধ্যমে এ বিষয়ে অবশ্য কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ইসরায়েলের সঙ্গে দীর্ঘদিনের ছায়াযুদ্ধে লিপ্ত ইরান এর আগেও বহুবার মোসাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে অনেক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে ও মৃত্যুদ- দিয়েছে। বিশেষ করে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ব্যাহত করতে নাশকতা বা হত্যাচেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগে তাদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গতকাল জানিয়েছেন, চলমান সংঘাত বন্ধে ইরান ও ইসরায়েল ‘একটি চুক্তিতে পৌঁছাবে’। তিনি বলেন, সংঘাত বন্ধে করতে বহু ফোনকল ও বৈঠক এখন চলছে। নিজের মালিকাধীন ট্রুথ সোশ্যালে তিনি এক পোস্টে লিখেছেন, ‘ইরান ও ইসরায়েলের একটি চুক্তিতে পৌঁছানো উচিত; দুই দেশে চুক্তিতে পৌঁছাবে, যেমনটা আমি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে করিয়েছিলাম।’ তিনি উল্লেখ করেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম মেয়াদে চরম উত্তেজনায় থাকা সার্বিয়া-কসোভো এবং মিসর-ইথিওপিয়ার মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি।

ট্রাম্প বলেন, ‘তেমনিভাবে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যেও আমরা খুব শিগগির শান্তি প্রতিষ্ঠা করব। এখন বহু ফোনালাপ ও বৈঠক চলছে। আমি অনেক কিছু করি, কিন্তু কখনো কৃতিত্ব পাই না, তবে ঠিক আছে, জনগণ বোঝে। মেক দ্য মিডল ইস্ট গ্রেট অ্যাগেইন!’

(এই প্রতিবেদন তৈরিতে তাসনিম নিউজ, বিবিসি, রয়টার্স, আল জাজিরা ও দ্য গার্ডিয়ানের তথ্য নেওয়া হয়েছে।)