নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই চ্যালেঞ্জ

সাজ্জাদ মাহমুদ খান
১৬ জুন ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই চ্যালেঞ্জ

অন্তর্বর্তী সরকার ও অন্যতম প্রধান দল বিএনপি আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে একমত হয়েছে। ভোটের জন্য নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও প্রস্তুত, বলছে সরকার। কিন্তু আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের সমান নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। জুলাই আন্দোলনের সময় থানা থেকে লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রে নির্বাচনকালে সহিংসতার আশঙ্কা সৃষ্টি করছে। সেই সঙ্গে পাশর্^বর্তী দেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি, ডিপফেক ভিডিও-ছবি তথা গুজব প্রতিরোধে পুলিশের দুর্বলতাও সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিতে পারে।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যখনই হোক, নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সঙ্গে নির্বাচনকালীন সময়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা নিবিড়ভাবে জড়িত। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১০ মাস পার হলেও ছিনতাই, ডাকাতি, মব ভায়োলেন্স ও ক্ষমতার অপব্যবহার সহনীয়পর্যায়ে আনতে পারেনি পুলিশ। প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা বিভিন্নভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এভাবে চলতে থাকলে নির্বাচনের সময়ও এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে নির্বাচনের সময় বড় দলগুলো প্রশাসন ও ভোটারদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ছোট দলগুলোকে নির্বাচনকালীন সময়ে নিরাপত্তা ও সমান সুযোগ দিতে ব্যর্থ হতে

পারে পুলিশ-র‍্যাব। তবে বড় দলগুলোর স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক সদিচ্ছাই শুধু পারে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে। তাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপরও চাপ কমবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রস্তুতিই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। স্থানীয়পর্যায়ে রাজনৈতিক কোন্দল, গ্যাং কালচার, দখলবাজি ও নির্বাচনী সহিংসতার আশঙ্কা করছেন তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত শুক্রবার লন্ডনে বৈঠকের শুরুতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে এপ্রিল নাগাদ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের ইচ্ছার কথা জানান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অন্যদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং প্রচারের ক্ষেত্রে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ বজায় রাখার বিষয়ে তার দলের পক্ষ থেকে সরকারকে সব রকম সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন। পরে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস রমজানের আগে শর্তসাপেক্ষে ভোট আয়োজনে তার প্রাথমিক সম্মতি জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক আমাদের সময়কে বলেন, তুলনামূলকভাবে বড় রাজনৈতিক দলগুলো যে কোনো উপায়ে জয় চায়। এসব ক্ষেত্রে তাদের লক্ষ্য থাকে প্রতিপক্ষকে দমন করা। তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে বর্তমান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে অবস্থা, তাতে নির্বাচনকালে তারা পুরো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে কিনা না তা নিয়ে সন্দেহ করার কারণ রয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারণীদের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যতই ভালো বলা হোক, এর সঙ্গে মাঠপর্যায়ের ঢের ফারাক রয়েছে।

সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল ইসলাম আরও বলেন, অবৈধ অস্ত্র প্রতিটি প্রার্থীর জন্যই সমান চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। এ ছাড়া ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বরাবরই দুর্বল। উপরন্তু পাশর্^বর্তী দেশের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্কের টানাপড়েন, সেটাও নির্বাচনের ওপর বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছাই শুধু পারবে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এখনো কোনো রোডম্যাপ তৈরি করা হয়নি। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ধারাবাহিক প্রস্তুতি থাকে। অস্ত্র উদ্ধার, সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার ও সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণও এ প্রস্তুতির অংশ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের চেষ্টা চলছে। নির্বাচনের আগেই পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে। এ ছাড়া নির্বাচনের সময়কাল নির্ধারিত হলে অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসী গ্রেপ্তারের বিশেষ অভিযানও চালানো হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নির্বাচনে তফসিল ঘোষণা করলে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যদের নিয়ে রোডম্যাপ তৈরি করা হবে। প্রত্যন্ত এলাকাসহ ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র চিহ্নিত করে সেখানে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সামাজিকমাধ্যমে গুজব, উসকানি ও বিভ্রান্তিকর তথ্য রোধে পুলিশের সাইবার ইউনিটগুলোকে আরও বেশি সক্রিয় করার পরিকল্পনা রয়েছে। নির্বাচন ঘিরে ভুয়া তথ্য প্রচারে জড়িতদের চিহ্নিত করতে প্রযুক্তিনির্ভর মনিটরিং সেল গঠন করা হবে। পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পুলিশ সপ্তাহে নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়। সেখানে নির্বাচনকালে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারের পাশাপাশি অনলাইনে গুজব ঠেকানোর বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হিসেবে উঠে আসে। পুলিশ কর্মকর্তারা গুজব ঠেকানোর জন্য বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়ার কথাও গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন।