কর অব্যাহতি প্রত্যাহারে চাপ বাড়বে স্থানীয় শিল্পে

আবু আলী
১২ জুন ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
কর অব্যাহতি প্রত্যাহারে চাপ বাড়বে স্থানীয় শিল্পে

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে প্রস্তাবিত বাজেটে কর অব্যাহতি প্রত্যাহারের মাধ্যমে স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষা কমানো হয়েছে। অন্যদিকে রাজস্ব আয় বাড়াতে সুতা উৎপাদনে ভ্যাট এবং লোকসানি প্রতিষ্ঠানেরও কর বাড়ানো হয়েছে। আবার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের স্থান-স্থাপনা ভাড়ার উৎসেও কর বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে স্থানীয় শিল্প ও বিনিয়োগকে চাপে ফেলা হয়েছে। এসব উদ্যোগের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে কঠিন করতে ভূমিকা রাখতে পারে।

জানা গেছে, আগামী বছরের নভেম্বরে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে উত্তরণ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের। এই প্রেক্ষাপট এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক শুল্কবৃদ্ধির প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে প্রায় ৫০০টি পণ্যে আমদানি শুল্ক ব্যাপকভাবে কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, এমন কিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে, এতে স্থানীয় আমদানি বিকল্প শিল্পগুলো বাড়তি প্রতিযোগিতায় পড়তে পারে। তারা বলছেন, এলডিসি-পরবর্তী সময়ে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্য থাকলেও যেসব পণ্য দেশেও উৎপাদন হয়, সেগুলোর শুল্ক কমানোয় ওই খাতগুলোর শিল্প প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের গতি শ্লথ হতে পারে।

এদিকে, প্রস্তাবিত বাজেটে দেশীয় টেক্সটাইল মিলে তৈরি সুতা উৎপাদনে ভ্যাট হার বাড়ানো হয়েছে। এতে আরও চাপে পড়বে গ্যাস সংকটে ধুঁকতে থাকা টেক্সটাইল মিলগুলো। প্রতি কেজি কটন সুতা ও ম্যানমেইড ফাইবারে তৈরি সুতার সুনির্দিষ্ট কর ৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ টাকা করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের এ সিদ্ধান্তের ফলে ভারতীয় সুতার সঙ্গে প্রতিযোগী সক্ষমতায় আরও পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন মিল মালিকরা।

অন্যদিকে, প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক খাতেও করের বোঝা চাপানো হয়েছে। অব্যাহতি সংস্কৃতি পরিহার করতে রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার, পলিপ্রোপাইন স্টাপল ফাইবারের ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ ছাড়া মোবাইল ফোন উৎপাদনে হ্রাসকৃত ভ্যাট হার বাড়ানো হয়েছে। এতে ইলেকট্রনিক্স শিল্পের সুরক্ষা কমবে, বিদেশি ইলেকট্রনিক্সসামগ্রীর আমদানি বাড়বে। পাশাপাশি ক্রেতার খরচ

বাড়বে। আবার গ্রামাঞ্চলে ব্যবহৃত সিমেন্ট শিট উৎপাদনে ৫ শতাংশ ভ্যাট আছে, এটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। স্টিল শিল্পের কাঁচামাল ফেরো ম্যাঙ্গানিজ ও ফেরো সিলিকা ম্যাঙ্গানিজ অ্যালয় উৎপাদনে টনপ্রতি এক হাজার টাকা ভ্যাট আছে, এটি এক হাজার ২০০ করা হয়েছে। ফেরো সিলিকন অ্যালয়ের ভ্যাট দেড় হাজার টাকা করা হয়েছে। উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট হার বাড়ানো হয়েছে হোম অ্যাপ্লায়েন্স বা গৃহস্থালিসামগ্রী উৎপাদনে। ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেকট্রিক ওভেন, ব্লেন্ডার, জুসার, মিক্সার, ইলেকট্রিক কেটলি, আয়রন, রাইস কুকার, মাল্টি কুকার ও প্রেশার কুকার উৎপাদনে ২০২৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ৫ শতাংশ, ২০২৯ সালের জুন পর্যন্ত সাড়ে ৭ শতাংশ এবং ২০৩০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ১০ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। লিফটের ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করে উৎপাদনের জন্য উপকরণ ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে বছরভিত্তিক ভ্যাট হার বাড়ানো হয়েছে।

প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, শিল্পের লাভ-লোকসান যাই হোক- বাজেটে দ্বিগুণ হারে এক শতাংশ ন্যূনতম আয়কর দিতে হবে। অবশ্য টার্নওভারের সীমা এক কোটি টাকা বাড়িয়ে ৪ কোটি টাকা করা হয়েছে। এ পদক্ষেপের ফলে ব্যবসা-শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আবার ব্যবসা পরিচালনার জন্য রাজধানীর প্রায় সব প্রতিষ্ঠানকে স্থান-স্থাপনা ভাড়া নিতে হয়। স্থান-স্থাপনা ভাড়ার উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। সাধারণত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকেই এ খরচ বহন করতে হয়। ব্যবসার প্রচারমূলক কর্মকা-ের জন্য সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করতে কনভেনশন হল, কনফারেন্স সেন্টার ভাড়া নিতে হয়। এ ধরনের হল ভাড়ার উৎসে কর দ্বিগুণ করে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। স্থান-স্থাপনা ভাড়া বা কনফারেন্স সেন্টার ভাড়ার ওপর উৎসে কর বাড়ানোয় ব্যবসা খরচ বাড়বে।

এ ছাড়া শিল্পের কর অবকাশ সুবিধাও বাতিল করা হয়েছে। বর্তমানে ৩১টি শিল্পখাত ১০ বছরের জন্য অঞ্চলভেদে ক্রমহ্রাসমান হারে কর অবকাশ সুবিধা ভোগ করছে। শিল্প খাতগুলো হচ্ছে- অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রিডিয়েন্ট, কৃষি যন্ত্রপাতি, ব্যারিয়ার কন্ট্রাসেপটিভ ও রাবার ল্যাটেক্স, ইলেকট্রনিক্সের মৌলিক উপাদান (রেজিস্টর, ক্যাপাসিটর, ট্রানজিটর, ইন্ট্রিগ্রেটেড সার্কিট ও মাল্টিলেয়ার পিভিসি); বাইসাইকেল ও এর যন্ত্রাংশ, বায়ো ফার্টিলাইজার; বায়োটেকনলজি ভিত্তিক কৃষিপণ্য, বয়লারের খুচরা যন্ত্রাংশ ও সরঞ্জামসহ কম্পিউটার হার্ডওয়্যার, আসবাবপত্র, হোম অ্যাপ্লায়েন্স (ব্লেন্ডার, রাইস কুকার, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেকট্রিক ওভেন, ওয়াশিং মেশিন, ইনডাকশন কুকার, ওয়াটার ফিল্টার), কীটনাশক ও বালাইনাশক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, এলইডি টিভি, ফলমূল ও শাকসবজি প্রক্রিয়াকরণ, মোবাইল ফোন, পেট্রোকেমিক্যাল; ফার্মাসিউটিক্যালস; প্লাস্টিক রিসাইক্লিং; টেক্সটাইল মেশিনারি; টিস্যু গ্রাফটিং; খেলনা উৎপাদন; টায়ার ম্যানুফ্যাকচারিং, ইলেকট্রিক্যাল ট্রান্সফরমার, ম্যানমেইড ফাইবার উৎপাদন, অটোমোবাইল যন্ত্রাংশ ম্যানুফ্যাকচারিং, রোবটিক্স ডিজাইন, এআই-ভিত্তিক সিস্টেম ডিজাইন, ম্যানুফ্যাকচারিং, ন্যানোটেকনোলজি ভিত্তিক পণ্য ম্যানুফ্যাকচারিং এবং এয়ারক্রাফট হেভি মেইনটেন্যান্স সার্ভিস ও খুচরা যন্ত্রাংশ ম্যানুফ্যাকচারিং।

ব্যবসায়ীরা জানান, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে নতুন করে বিনিয়োগ বা ব্যবসা সম্প্রসারণে আগ্রহী হওয়ার মতো পদক্ষেপ তুলনামূলক কম; বরং নতুন করে বিনিয়োগ বা ব্যবসা বাড়াতে গেলে খরচ বাড়বে। এ ছাড়া গত কয়েক দশকে আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদনে স্থানীয়ভাবে যেসব শিল্প গড়ে উঠেছে, সেগুলোর সুরক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ নেই। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু খাতে সামান্য সুবিধা দেওয়া হয়েছে; কিন্তু সামগ্রিকভাবে স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষার বিষয়টি এখনও নিশ্চিত হয়নি; বরং স্থানীয় শিল্প কোথাও কোথাও আমদানি পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পড়বে।