সেনা অভিযানে মিয়ানমার সীমান্তের শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার, জনমনে স্বস্তি
মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে গরু ও মাদক চোরাচালানে জড়িত চক্রের প্রধান এবং আরকান আর্মির বিজনেস পার্টনার রামুর গর্জনিয়ার যুবলীগ নেতা শাহীনুর রহমান ওরফে শাহীনকে (৩২) গ্রেপ্তারের পর স্বস্তি ফিরেছে জনমনে। এলাকাবাসীর প্রত্যাশা এবার সীমান্তবর্তী এলাকাজুড়ে চলমান হত্যা, চোরচালান, ডাকাতি অনেকাংশে কমে আসবে। দূর্ধর্ষ ডাকাত শাহীনকে গ্রেপ্তার করায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে এলাকাবাসী।
পবিত্র ঈদুল আযহার দুইদিন আগে গত বৃহস্পতিবার সকালে গর্জনিয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান ইউপির সদস্য ও তার শ্বশুর শাকের আহমদের বাড়ি থেকে ডাকাত শাহীনকে গ্রেপ্তার করে সেনা বাহিনী।
রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ি থানার পুলিশ ও বিজিবি সূত্রে জানা যায়, গত এক দশকের বেশি সময় ধরে মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে গরু ও মাদক চোরাচালান সিন্ডিকেট চালাচ্ছিলেন শাহীন। র্যাব-পুলিশ একাধিকবার অভিযান চালিয়েও তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। তবে সেনাবাহিনীর অভিযানে তিনি এবার ধরা পড়ায় সীমান্ত জনপদের মানুষ আনন্দে আত্মহারা।
সেনাবাহিনী জানায়, শাহীনের বিরুদ্ধে হত্যা, ডাকাতি, অস্ত্র, মাদকসহ ২০টি মামলা রয়েছে। তার নামে গঠিত ‘শাহীন বাহিনী’র প্রায় ৪০৪৫ জন সদস্য রয়েছে, যাদের কাছে রয়েছে ভারী অস্ত্র, মাদক ও বিপুল পরিমাণ টাকা।
সেনাবাহিনীর রামু ১০ পদাতিক ডিভিশনের লেফটেন্যান্ট কর্নেল মনোয়ার হোসেন এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে সেনাবাহিনীর চারটি দল গত ৫ জুন শ্বশুর বাড়ি থেকে শাহীনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর তার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে একটি একে ২২, তিনটি একনলা বন্দুক, ২০ হাজার ইয়াবা, ১০টি ধারাল অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করা হয়। এ সময় আরও দুজন সহযোগীকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
‘ত্রাসের রাজত্ব’ ও সিন্ডিকেটের উত্থান
স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, ২০১০ সালের দিকে ঈদগড়ের কালু ও কলিম ডাকাতের মাধ্যমে অপরাধজগতে প্রবেশ করেন শাহীন। পরে নিজেই ‘শাহীন বাহিনী’ গড়ে তোলেন। এই বাহিনী রাবার বাগান দখল, চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন ও মাদক চোরাচালানে জড়ায়।
স্থানীয় কয়েকজন জনপ্রতিনিধি জানান, ২০১৪ সালের পর সীমান্তে চোরাচালানের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ চলে যায় শাহীনের হাতে। তখন প্রতি মাসে মিয়ানমার থেকে এক লাখের বেশি গরু-মহিষ আসত। একই সঙ্গে ইয়াবা ও আইসের চালানও খালাস হতো তার বাহিনীর মাধ্যমে। ২০২২ সালের পর রাখাইনে সংঘাত শুরু হলে সীমান্তে তার প্রভাব আরও বাড়ে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে র্যাব শাহীনকে গ্রেপ্তার করলেও জামিনে বেরিয়ে আবার সক্রিয় হন তিনি।
খুন-নির্যাতন-ভয়ভীতির রাজত্ব
স্থানীয় মানুষেরা জানান, চোরাচালান রোধে প্রতিবাদ করায় গত কয়েক বছরে অন্তত ১২টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০২৪ সালের ১৬ মার্চ গুলিতে নিহত হন থিমছড়ির আবু তালেব, ২২ এপ্রিল নিহত হন জাফর আলম ও তাঁর ছেলে সেলিম, ৮ মে খুন হন আবুল কাশেম। তার বিরুদ্ধাচরণ করায় ইউপি সদস্য মনিরুলের পা ভেঙে দেন বাহিনীর সদস্যরা। প্রতিবন্ধী নুরুল আবছারও গুলিবিদ্ধ হন।
২০২৪ সালের ৩ জুন মাদক চোরাচালানে বাধা দিতে গিয়ে বিজিবির সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন শাহীন বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড নেজাম উদ্দিন।
নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাসরুরুল হক জানান, শাহীন দীর্ঘদিন ধরে সীমান্তে চোরাচালান সিন্ডিকেট চালিয়ে আসছিলেন। তার বিরুদ্ধে ২০টি মামলা রয়েছে।
রামু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তৈয়বুর রহমান জানান, সেনা অভিযানের পর এলাকাজুড়ে স্বস্তি ফিরেছে। তাকে রিমান্ডে এনে পুরো সিন্ডিকেট চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।বিজিবির নাইক্ষ্যংছড়ি ১১ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কফিল উদ্দিন কায়েস এবং র্যাব-১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামরুল হাসান জানিয়েছেন, সীমান্তে চোরাচালান ও সন্ত্রাস দমনে যৌথ অভিযান চলমান থাকবে।