লিজের দুই উড়োজাহাজ বিমানের গলার কাঁটা
রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বহরে নিজস্ব উড়োজাহাজের পাশাপাশি রয়েছে লিজ নেওয়া বিমানও। বর্তমানে বহরে থাকা ৬টি বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজের মধ্যে ২টি ড্রাই লিজ পদ্ধতিতে মিশরের প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেওয়া হয়। লিজের মেয়াদ শেষ হওয়ায় উড়োজাহাজ ২টি ফেরত চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এ ক্ষেত্রে লিজে দেওয়ার সময় যে অবস্থায় ছিল, সে অবস্থায় উড়োজাহাজ দুটি ফেরত চেয়েছে ওই প্রতিষ্ঠান। উড়োজাহাজ দুটি সংস্কার করে ফেরত দিতে বিমান কর্তৃপক্ষের দুশ থেকে আড়াইশ কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে।
সূত্র আরও জানায়, সাধারণত এয়ারলাইন্সগুলো দুটি পদ্ধতিতে উড়োজাহাজ ভাড়া নিয়ে থাকে। একটি ওয়েট লিজ, আরেকটি ড্রাই লিজ। ওয়েট লিজ পদ্ধতিতে স্বল্পমেয়াদে উড়োজাহাজ ভাড়া নেওয়া হয়। এ পদ্ধতিতে উড়োজাহাজের ফ্লাইট ব্যবস্থাপনা থাকে লিজদাতা প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে। এ পদ্ধতিটি তুলনামূলক ব্যয়বহুল। ড্রাই লিজ পদ্ধতিতে দীর্ঘমেয়াদে উড়োজাহাজ ভাড়া নেওয়া হয়। এ পদ্ধতিতে উড়োজাহাজের ব্যবস্থাপনা থাকে লিজ গ্রহীতা এয়ারলাইন্সের দায়িত্বে। লিজের চুক্তি অনুযায়ী, উড়োজাহাজ ২টি ফেরত দেওয়ার সময় এটিকে যে অবস্থায় লিজ নেওয়া হয়েছিল সে অবস্থায় দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এর মধ্যে ১টি উড়োজাহাজ হ্যাঙ্গারে বসে আছে, অপরটি দিয়ে ফ্লাইট চালানো হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ৫ বছরের চুক্তিতে মিশরের ‘আলাফকো’ কোম্পানির কাছ থেকে বোয়িং ৭৩৭-৮০০ এস২-এইকিউ এবং এস২-এইডব্লিউ উড়োজাহাজ ২টি ড্রাই লিজ পদ্ধতিতে ভাড়া নেয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। সেই ৫ বছরের মেয়াদ শেষ হয়েছে। বিমান কর্তৃপক্ষ লিজের মেয়াদ আরও বাড়াতে চায়। কিন্তু লিজদাতা মিশরীয় প্রতিষ্ঠান লিজের মেয়াদ না বাড়িয়ে উড়োজাহাজ ২টি ফেরত চেয়েছে।
আলাফকো জানিয়েছে, বুলগেরিয়ার সঙ্গে তাদের চুক্তি রয়েছে। সেখানে বিমান দুটি পাঠিয়ে সংস্কার করতে হবে। আর রঙ করতে হবে হাঙ্গেরিতে। উড়োজাহাজ ২টি সংস্কার করে ফেরত দিতে বিমানের দুশ থেকে আড়াইশ কোটি টাকা খরচ হবে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
এর আগেও ২০১৪ সালে পাঁচ বছরের চুক্তিতে ইজিপ্ট এয়ার (মিশর) থেকে বোয়িং ৭৩৭-২০০ ইআর নামে দুটি উড়োজাহাজ লিজ নেয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এতে বিমানের ১১৬১ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। এ বিষয়ে দুদকে মামলা চলমান রয়েছে। এ ছাড়া ১৩ বছর লিজে চালানোর পর আয়ারল্যান্ডের কাছ থেকে দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ প্রায় ১৬৮ কোটি টাকায় কিনে নেয় বিমান। কারণ করোনাকালে বেশি লাভের আশায় ভাড়া নেওয়া এই দুটি উড়োজাহাজকে মালামাল পরিবহনে ব্যবহার করা হয়। ফলে এতে উড়োজাহাজ দুটির আসন, হাতল, বিনোদন ব্যবস্থা, অভ্যন্তরীণ সজ্জা, টয়লেট, মেঝে, লাগেজ রাখার ওভারহেড কেবিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এজন্য উড়োজাহাজ দুটির মালিক তা ফেরত নিতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে ২০০১ সালে তৈরি করা পুরনো এ উড়োজাহাজ দুটি নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও তা কিনতে বাধ্য হয় বিমান। এখন মাঝে মাঝেই উড়োজাহাজ ২টিতে নানা সমস্যা দেখা দেয়।
মিশরীয় প্রতিষ্ঠান থেকে লিজে আনা উড়োজাহাজ দুটি গত ২২ মে ও ২৮ মে বুলগেরিয়ায় পাঠানোর কথা ছিল। সেটা সম্ভব হয়নি। ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ইনস্পেকশন করে তারপর পাঠাবে। চলতি ৬ জুন পাঠানোর কথা রয়েছে। এতে বিমানের লোকসানের বোঝা তো বাড়বেই, উপরন্তু বহর থেকে ২টি উড়োজাহাজ কমে যাওয়ায় ফ্লাইট শিডিউলও কাটছাঁট করতে হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে বিমান।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি এয়ারক্রাফট কিনতে ৫শ কোটি টাকা লাগে। সেই টাকা দিয়ে ৪-৫টি উড়োজাহাজ ড্রাই লিজ চুক্তি করা যায়। আর্থিক সক্ষমতা থাকলে নিজস্ব এয়ারক্রাফট দিয়েই ব্যবসা করা উত্তম। কিন্তু প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দিতে না পারলে লিজ নিতে হয়। বেশি এয়ারক্রাফট থাকলে শিডিউল মেইনটেইন করা সম্ভব হয়। এখন মার্কেটে এয়ারক্রাফট সংকট চলছে। লিজ বা কেনার জন্য এয়ারক্রাফট পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যবসা পলিসি ঠিক থাকলে ড্রাই লিজে এনেও লাভ করা সম্ভব।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এয়ারলাইন্সের এক কর্মকর্তা বলেন, অনেক এয়ারলাইন্স ড্রাই লিজ ও ওয়েট লিজ পদ্ধতিতে উড়োজাহাজ ভাড়া নেয়। এভাবে তারা ফ্লাইট শিডিউল মেইনটেইন করে। বিমান এর আগেও মিশর থেকে ২টি উড়োজাহাজ লিজ নিয়ে ১ হাজার ১৬১ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে যাতে বিমানের লোকজনই জড়িত।
লিজে আনা ২টি উড়োজাহাজের বিষয়ে জানতে গতকাল রবিবার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. সাফিকুর রহমানের সেলফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।