ব্রয়লার মুরগি ও বাচ্চার দামে বিপর্যয়
সিন্ডিকেটের অভিযোগ ভিত্তিহীন প্রমাণিত
ব্রয়লার মুরগির দর পতনে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন খামারিরা। ফলশ্রুতিতে খামার পরিচালনায় আগ্রহ হারিয়েছেন অধিকাংশ খামারি। ফলে চাহিদায় তীব্র ভাটা পড়েছে ব্রয়লার মুরগির এক দিন বয়সী বাচ্চার। এতে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে কমেছে বাচ্চার দাম।
জানা যায়, খামারি পর্যায়ে ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ কেজি প্রতি ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা হলেও চলতি মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে খামারিরা পাচ্ছেন ১২০ টাকার নিচে।
অতীতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন সময় পোল্ট্রি কোম্পানী ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যোগসাজশ (সিন্ডিকেট) করে ডিম আর মুরগির দাম বাড়ানোর অভিযোগ করা হয়েছে।
তবে এ খাত সংশ্লিষ্টরা যুক্তি তুলে ধরে বলেছেন, যদি এ খাতে সিন্ডিকেট থাকত তাহলে হ্যাচারিগুলো অতিরিক্ত বাচ্চা উৎপাদন করতো না এবং বাচ্চার দামও কখনো কমতো না। তারা আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলছেন, উৎপাদন খরচের তুলনায় ব্রয়লার বাচ্চা ও মুরগির অতিরিক্ত কম দাম অব্যাহত থাকলে পোল্ট্রি শিল্প ধ্বংসের মুখে পড়তে পারে। তাদের মতে, যে হারে খামারিরা পোল্ট্রি ব্যবসা ছাড়ছেন তা অব্যাহত থাকলে অনেক হ্যাচারি বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে নিকট ভবিষ্যতে একদিন বয়সী বাচ্চা এবং ব্রয়লার মুরগির তীব্র ঘাটতি দেখা দেবে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
গত ১৬ মে সরেজমিনে কিশোরগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকার খামার ঘুরে আলাপচারিতায় বেশ কয়েকজন খামারি ব্রয়লার মুরগির চলমান বাজার দরে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। বর্তমান অবস্থা দীর্ঘ দিন অব্যাহত থাকলে তাদের পক্ষে এ ব্যবসায় টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে বলেও মন্তব্য করেছেন।
এর মধ্যে জেলার করিমগঞ্জ থানার সিদলারপাড়ের ২ দশকের অভিজ্ঞ খামারি মোসলেহ উদ্দিন (৫৮) জানান, “অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে মুরগির খামার ব্যবসায় ধস নেমেছে। খরচ বৃদ্ধি ও দরপতনসহ নানা কারণে গত রোজার ঈদের পর থেকে অনেকে খামার করায় আগ্রহ হারিয়েছেন। শেডে বাচ্চা তুলছেন না। ৩০ টাকা দরে কেনা বাচ্চায় ১৪০ টাকা উৎপাদন খরচের মুরগি ১২০ টাকা করে বিক্রি করে গত এক ব্যাচে ৬০ হাজার টাকা লোকসানের তথ্য দিয়ে এই খামারি বলেন, বাচ্চার দাম সীমাহীনভাবে কমলেও বিক্রির সময় বেশি লোকসানের ভয়ে দুটি শেডের একটি বন্ধ রেখেছি।”
একই এলাকার তরুণ খামারি সাদ্দাম হোসেনের (৩৪) তিনটি শেডে সাড়ে ৬ হাজার পালনক্ষমতা থাকলেও মাত্র একটিতে ১২শ ব্রয়লার মুরগি পালন করছেন। তিনি জানান, “২৬ দিন আগে ২৭ টাকা দরে কেনা বাচ্চা পালন করেও নিশ্চিত লোকসানের ভয়ে রয়েছি। কোরবানীর ঈদের দেড় মাস পরও এ বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনাও ক্ষীণ।” সরেজমিন আলাপচারিতায় দেখা যায়, এ খাত সম্পর্কে গত কয়েক বছর ধরে পোল্ট্রি শিল্প উদ্যোক্তাদের বলা কথাগুলো এখন তৃণমূলের খামারিদের মুখেও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
এ প্রসঙ্গে কাজী ফার্মসের পরিচালক কাজী জাহিন হাসান বলেন, “এক দিনের বাচ্চার দাম ব্রয়লার মুরগির দামের উপর নির্ভর করে। ব্রয়লার মুরগির বাজার দর কম থাকলে খামারিরা বাচ্চা কিনতে চান না, তাই বাচ্চা মুরগির দামও কমে যায়। যখন ব্রয়লারের দাম বেশি থাকে, তখন সকল খামারিই বাচ্চা কিনতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন; ফলে উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেড়ে যায় এবং বাচ্চার দামও বৃদ্ধি পায়।”
চাহিদার তুলনায় উৎপাদন অনেক বেশি হওয়ায় এখন ব্রয়লারের দাম কম উল্লেখ করে তিনি বলেন, “চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে দাম নির্ধারণ হয়ে থাকে। গত বছর এক দিনের বাচ্চার দাম যখন বেশি ছিল, তখন হ্যাচারিগুলো বাচ্চার উৎপাদন বাড়ানোর ব্যবস্থা করেছিল; ফলে বর্তমানে বাজারে সরবরাহ বেশি। যদি যোগসাজশ করে উৎপাদন কমিয়ে দাম বাড়ানোর সিন্ডিকেট থাকতো তা হলে উৎপাদন কখনো এতো বেশি হত না এবং দামও এত কম হত না।”
এ খাতের অপর অন্যতম উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান প্যারাগন পোল্ট্রি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান বলেন, “উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে বলা হচ্ছে যে, মুরগির বাচ্চার দাম ব্রয়লার মুরগির দামের উপর নির্ভর করে; কিন্তু মহলবিশেষ দাম বৃদ্ধির জন্য অযৌক্তিকভাবে কথিত সিন্ডিকেটের ওপর দায় চাপিয়ে আসছেন। যা এ খাত সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব উস্কে দিয়েছে।” এখন এ খাত প্রকৃত অর্থেই সংকটে রয়েছে। এখান থেকে উত্তরণে অভিযোগকারী মহল কোনো পথ দেখাতে পারছে না।
বর্তমান পরিস্থিতিকে পোল্ট্রি খাতের জন্য বিপর্যয় উল্লেখ করে ব্রিডার্স এসোয়েশনের সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে প্রান্তিক খামারি- সবাই বাজারের করুণার উপর নির্ভরশীল। তিনি বলেন, হ্যাচারি কোম্পানীগুলো ৪৫ টাকা উৎপাদন খরচের এক দিনের বাচ্চা বিক্রি করছে মাত্র পাঁচ টাকা দরে। এতে প্রতিটি বাচ্চায় লোকসান ৪০ টাকা। হ্যাচারিগুলো সপ্তাহে এক কোটি ৯০ লাখের বেশি ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা উৎপাদন করে এবং বর্তমান বাজার দরে প্রতি সপ্তাহে কোটি কোটি টাকা লোকশান গুনছে। নিকট ভবিষ্যতে পোল্ট্রি পণ্যের আরও সংকটের পূর্বাভাস দিয়ে মাহবুব বলেন, “যারা পোল্ট্রি বাজার বোঝেন না, তারা সব সময় উদ্যোক্তাদের কল্পিত সিন্ডিকেটের উপর দোষারোপ করেন”- এটি অত্যন্ত দুঃখজনক।
তথ্যসূত্র : মোসলেহ উদ্দিন- ০১৯১৭৭১১৬৮৫, সাদ্দাম হোসেন- ০১৭১৫৭৩১২৫৪, জহির রায়হান বুলবুল- ০১৭৭৫৭০৪১৪৪, কাজী জাহিন হাসান- ০১৭১৩০৩৮১৭০, মশিউর রহমান- ০১৭১১৫২৬৯০২, মাহবুবুর রহমান-০১৭০৫৪৬৩৩৫০।