বাংলাদেশে কৃষিবান্ধব ব্যাংকিং

মাহফুজুর রহমান
০১ জুন ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বাংলাদেশে কৃষিবান্ধব ব্যাংকিং

সুপ্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষির ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত আগে এবং পরে মোট জাতীয় উৎপাদন খাতে কৃষির অবদান ছিল শতকরা ৬০ ভাগ। পরবর্তী সময়ে দেশে শিল্প ও সেবা খাতের অবদান পর্যায়ক্রমে বেড়ে গিয়েছে; এতে কৃষি খাতে উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কৃষি খাতের অবদান দাঁড়িয়েছে শতকরা ১১.০২ ভাগ। দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল।

প্রাচীন আমলে এদেশের কৃষিজীবী মানুষ ঋণের জন্য স্থানীয় মহাজনদের ওপর নির্ভরশীল ছিল। মহাজনদের দেওয়া ঋণের সুদহার ছিল অত্যন্ত উঁচু। তারা প্রায়শই ঋণদানের বিপরীতে উৎপাদিত শস্য দ্বারা ঋণের টাকা ফেরত নিত। ফলে কৃষক বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো। পাকিস্তান আমলে ধীরে ধীরে কৃষি খাতে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণদান শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে সমবায় সমিতি ও কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক দেশে কৃষিঋণ বিতরণের দায়িত্ব পালন করে। স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পর দেখা যায় যে, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণকৃত কৃষিঋণের পরিমাণ ৩৭.২২ কোটি টাকা; যার ভেতর ১৮.১৬ কোটি টাকা মেয়াদোত্তীর্ণ। কৃষি খাতকে চাঙা করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ১৯৭৩ সালের ৩০ জুনের ভেতর বিতরণের উদ্দেশ্যে মোট ৬১ কোটি ৬০ লাখ টাকা ঋণ মঞ্জুর করে যার মধ্যে ৩৮ কোটি ১০ লাখ টাকা সমবায় সমিতির জন্য এবং ২৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের জন্য। উভয় প্রতিষ্ঠানই মঞ্জুরিকৃত ঋণের পুরোটা বিতরণ করতে ব্যর্থ হয়। তবে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে দেশে ধান উৎপাদনে সহযোগিতা করার লক্ষ্যে আরও ঋণ প্রদান করা হয়। এ পর্যায়ে ১৯৭৩ সালে চা এবং মৎস্য খাতেও ঋণ বিতরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক উৎসাহ প্রদান করে।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে কৃষিঋণ প্রদানে বৈপ্লবিক পদক্ষেপ আসে ১৯৭৭ সালের ৩১ জানুয়ারি। এই প্রথমবারের মতো একটি বৃহৎ অঙ্কের ঋণ কেবল কৃষি খাতে বিতরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক মঞ্জুর করে। এ পর্যায়ে দেশের সর্বত্র জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করে এবং জেলা-ভিত্তিক লিডব্যাংক নিয়োগ করে ব্যাপক আকারে কৃষিঋণ বিতরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এ সময় দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে ঋণপ্রবাহ কার্যকর করার উদ্দেশ্যে কোন ইউনিয়নে কোন ব্যাংক ঋণ বিতরণ করবে তা ভাগ করে দেওয়া হয়। জেলা প্রশাসকগণ এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এই ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে তদারকি করে এবং কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়ন করে।

বাংলাদেশে কৃষিঋণের গুরুত্ব বিবেচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের সব শ্রেণির ব্যাংকের জন্য কৃষিঋণ বিতরণে অংশ নেওয়া বাধ্যতামূলক করে। এতে করে ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়েই বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় কৃষিঋণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে এবং তুলনামূলকভাবে সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়।

কৃষি খাতে পর্যাপ্ত ঋণ সরবরাহের মাধ্যমে কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে প্রতিবছরই কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা তৈরি করা হয়ে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রবর্তিত ২০২৪-২৫ সালের কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালার আওতায় দেশব্যাপী কাজ চলছে। এই নীতিমালা তৈরির ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন, জাতীয় কৃষিনীতি এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নকে বিবেচনায় রাখা হয়।

দেশে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে কৃষি খাতে পর্যাপ্ত ঋণপ্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩৮ হাজার কোটি টাকা কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এই লক্ষ্যমাত্রা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ৮.৫৭ শতাংশ বেশি। বিগত অর্থবছরে এই লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা। তবে ব্যাংকগুলো কর্তৃক গত বছর ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার ১৫৩.৯০ কোটি টাকা। কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালার আওতায় স্বল্প সুদহারে পর্যাপ্ত ঋণ বিতরণের লক্ষ্যে স্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকসমূহকে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ন্যূনতম শতকরা ৫০ ভাগ কৃষি ও পল্লী ঋণ নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এবং আবশ্যিকভাবে উক্ত লক্ষ্যমাত্রার শতকরা ৬০ ভাগ শস্য ও ফসল খাতে, শতকরা ১৩ ভাগ মৎস্য খাতে এবং শতকরা ১৫ ভাগ প্রাণিসম্পদ খাতে বিতরণের বাধ্যবাধকতা প্রদান করা হয়েছে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ৩৭ লাখ ৪১ হাজার ৩৮৬ জন কৃষক কৃষি ও পল্লী ঋণ পেয়েছেন। এর মধ্যে নারী ঋণ গ্রহীতা রয়েছেন ১৯ লাখ ২১ হাজার ৪২৪ জন; নারী ঋণগ্রহীতাগণ কর্তৃক গৃহীত ঋণের পরিমাণ ১৩ হাজার ৯৫৬.৭২ কোটি টাকা। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কৃষি ঋণ প্রদানের উদ্দেশ্যে ইউনিয়ন পর্যায়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, কৃষি কর্মকর্তা, শিক্ষক এবং অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতিতে বিভিন্ন ব্যাংকের উদ্যোগে প্রকাশ্যে কৃষি ঋণ বিতরণ করা হয়। কৃষিঋণ বিতরণের জন্য আবেদনকারীকে একটি হিসাব খুলতে হয়। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির সুবিধার্থে মাত্র ১০ টাকা জমা রেখে ব্যাংকে হিসাব খোলা যায়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিভিন্ন ব্যাংক কর্তৃক আয়োজিত মোট ২১ হাজার ৮৮১টি প্রকাশ্য ঋণ বিতরণ কর্মসূচির মাধ্যমে মোট ১,২৮,৬৯৭ জন কৃষকের মাঝে প্রায় ১,২৩৮.২৭ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৮ লাখ ২৩ হাজার ৫৩০ জন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ২৪,৮৪৪.৭১ কোটি টাকা কৃষিঋণ পেয়েছেন। আবার একই অর্থবছরে চর, হাওর প্রভৃতি অনগ্রসর এলাকার ৪,৩৭৫ জন কৃষককে বিভিন্ন ব্যাংক প্রায় ২৫.৭৮ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লী ঋণ দিয়েছে।

কৃষি ঋণ বিতরণ ও গ্রামীণ জনপদে দরিদ্র কৃষকগণের মধ্যে সরকারি অনুদান যথাযথভাবে বিতরণের সুবিধার্থে কৃষকগণকে ১০ টাকা জমা দিয়ে ব্যাংকে হিসাব খোলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়কালে পাওয়া পরিসংখ্যান হতে দেখা যায় যে, ব্যাংকসমূহে এ ধরনের ১০ টাকা জমার হিসাব চালু আছে ১ কোটি ৪ লাখ ২ হাজার ৪৫৭টি। এরূপ হিসাবে কৃষকগণ ঋণের পাশাপাশি অনুদানের টাকাও পেয়ে থাকেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু কিছু খাতে আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদনের প্রয়োজনে কম সুদহারে ঋণ বিতরণের ব্যবস্থা করেছে। এ পণ্যগুলো হচ্ছে, ডাল, তৈলবীজ, মসলা জাতীয় ফসল ও ভুট্টা। এসব শস্য উৎপাদনের জন্য কৃষকদেরকে শতকরা ৪ রেয়াতি সুদহারে ঋণ বিতরণ করা হয়ে থাকে। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্নভাবে ব্যাপক প্রচার করেছে; ফলে এ জাতীয় ফসল আবাদ করার বিষয়ে কৃষকদের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এই নীতিমালায় বেশ কিছু নতুন বিষয় সংযোজন করা হয়েছে। যেমনÑ কৃষির উৎপাদন খাতে ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক বিনিয়োগ পদ্ধতি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে চার্জ ডকুমেন্ট শিথিলকরণ, কৃষি ও পল্লী ঋণের পরিধি ও আওতা বর্ধিতকরণ, নতুন কতগুলো শস্য ও ফসলের ঋণ নিয়মাচার অন্তর্ভুক্তকরণ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ঋণ বিতরণের উদ্দেশ্যে নতুন কিছু উপখাত সংযোজন ইত্যাদি।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান বাধা মূল্যস্ফীতি। চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। খাদ্য সরবরাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে নিত্যপণ্যের বাজারমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার উদ্দেশ্যে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ খাতে প্রণোদনামূলক পুনঃঅর্থায়ন স্কিম চালু আছে। কৃষিঋণে গত কয়েক বছর ধরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অধিক পরিমাণে কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণ সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের আগ্রহই প্রমাণ করে। বর্তমানে ব্যাংক থেকে কৃষি ও পল্লী ঋণ গ্রহণ করায় কোনো বাধা নেই এবং কৃষকগণকে কোনোরূপ হয়রানির শিকার হতে হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে ব্যাংকগুলো এভাবে কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণ ও আদায় কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারলে ভবিষ্যতে দেশে কৃষিজাত উৎপাদন আরও বাড়বে এবং দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা সম্ভব হবে।

লেখক : লেখক ও প্রাক্তন নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক