অর্থনীতিতে বাড়ছে এসএমইর অবদান
দেশের অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতের অবদান বাড়ছে। গত চার দশকে এ খাতে উৎপাদন ক্রমে বেড়েছে। গত দুই দশক দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এই খাতের অবদান ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে এসএমই খাতের অবদান ৩০ শতাংশেরও বেশি। আবার সবচেয়ে বড় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতও এটি। কিন্তু এই খাতে অর্থায়ন, নীতিমালা ও পণ্য বাজারজাতকরণে সমস্যা রয়েছে। তাই সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এসএমই খাতকে এগিয়ে না নিলে সার্বিকভাবে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্টরা এ খাতের উন্নয়নে বেশ কিছু সুপারিশ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে- সহজ শর্তে জামানতবিহীন ঋণ প্রদান ও সরকারের ভর্তুকি বাড়ানো। দক্ষতা বাড়াতে দরকার প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহায়তা, ই-কমার্স ও ডিজিটাল মার্কেটপ্লেসে এসএমইর সংযুক্তি, কর কাঠামো ও লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া সহজ এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশে সহায়তায় প্রদর্শনীর আয়োজন করা।
শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, দেশে সত্যিকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে এসএমই খাতের উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এসএমই খাত শুধু ব্যবসা নয়, দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। এসএমই উদ্যোক্তারা তাদের লাভের ৩০ শতাংশই পুনরায় বিনিয়োগ করেন, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
এসএমই ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এসএমই খাতের অবদান প্রায় ৩২ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে, দেশে ৭৮ লাখের বেশি কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এটি মোট শিল্প প্রতিষ্ঠানের ৯৯ শতাংশের বেশি। শিল্প খাতের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৮৫ শতাংশ হয় এসএমই খাতে। এ খাতে আড়াই কোটির বেশি জনবল কর্মরত।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে দেশে এসএমই কোম্পানির সংখ্যা ১ কোটি ১৮ লাখ। এ খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষের।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
বেশ কয়েকজন এসএমই উদ্যোক্তা, এসএমই ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা ও খাত বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তাদের অর্থায়নের ক্ষেত্রে অন্তত পাঁচ ধরনের সমস্যা রয়েছে। সমস্যাগুলো হচ্ছেÑ উচ্চ সুদহার, জামানত প্রদানের বাধ্যবাধকতা, প্রয়োজনীয় নথিপত্রের অভাব, ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি এড়ানোর মনোভাব এবং ব্যাংকবহির্ভূত বিকল্প অর্থায়ন সুবিধা না থাকা।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকিন আহমেদ বলেন, এসএমই খাতের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ অর্থায়নের অভাব। এ ছাড়া সুদের উচ্চহার, পর্যাপ্ত নীতিমালার অভাব ও পণ্য বাজারজাতকরণের সমস্যা রয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠান খুলতে কমপক্ষে ৩১টি নথি প্রয়োজন হয়। এসব কারণে এসএমইরা পিছিয়ে রয়েছে। অন্যদিকে এসএমই ঋণের বড় অংশই পান মাঝারি ব্যবসায়ীরা। কারণ এই ঋণের জন্য প্রয়োজনীয় সব কাগজ সংগ্রহ করা কটেজ ও অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এ কারণে এসএমই নীতিমালার নাম সিএমএসএমই করা এবং কটেজ ও মাইক্রোকেও আবশ্যকীয়ভাবে ঋণের আওতাযুক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি।
এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসারে বৈশ্বিকভাবে অনেকে চাকরি হারাচ্ছেন। বাংলাদেশেও এমন পরিস্থিতি হতে পারে। তখন অনেকেই আত্মকর্মসংস্থানের জন্য এসএমই খাতে আসবেন। সে জন্য এসএমই খাতের উন্নয়নে যথাযথ পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন। এসএমই খাত ঠিক পথে না গেলে পুরো দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এসএমই ফাউন্ডেশনের এমডি আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, এই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত ছোট পরিসরে পণ্য তৈরি করে। গত কয়েক বছরে দেখা গেছে, দেশের করপোরেট কোম্পানিগুলোও এসএমইদের এসব পণ্যের ব্যবসায়ে যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু বড় কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছেন না এসএমই উদ্যোক্তারা। এ জন্য উপযোগী নীতিমালা তৈরির মাধ্যমে এসএমই খাতকে টেনে তুলতে হবে। শুধু করপোরেট খাত দিয়ে দেশকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
এসএমই খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই খাতের জন্য বেশ কিছু ঋণ কর্মসূচি থাকলেও সেগুলো থেকে প্রত্যাশিত সুবিধা পাওয়া যায় না। ঋণের পাশাপাশি ব্যবসার নিবন্ধন, শুল্ক-কর, কাঁচামাল আমদানি, বিপণন প্রভৃতি পর্যায়েও অসুবিধার সম্মুখীন হন এসএমই উদ্যোক্তারা।
এসএমই ঋণ সম্প্রসারণে সরকারের নানা পদক্ষেপ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে, দেশের তফসিলি ব্যাংকের সব শাখায় একটি করে এসএমই ডেস্ক রাখার নিয়ম রয়েছে। এ ছাড়া নির্দেশনা রয়েছে ব্যাংকের মোট ঋণের অন্তত ২৫ শতাংশ সিএমএসএমই খাতে বিতরণের। তা সত্ত্বেও উদ্যোক্তারা কাক্সিক্ষত পরিমাণে ঋণ পাচ্ছেন না। বিশেষ করে কুটির, অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ঋণ পাওয়ার হার অনেক কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত অর্থবছরে সিএমএসএমই খাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের পরিমাণ (স্থিতি) ছিল ৩ লাখ ৬ হাজার ১২০ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের প্রায় ১৯ শতাংশ। ২০২৩ সালের তুলনায় গত বছর এসএমই ঋণের প্রবাহ বেড়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ বা ১ হাজার ২৭ কোটি টাকা।
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারিÑ সবারই বৈশিষ্ট্য ও ঋণের চাহিদা আলাদা। কিন্তু ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে মাঝারি ও ক্ষুদ্রদের চেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দেয়। এখান থেকে সরে এসে প্রত্যেকের জন্য আলাদাভাবে ঋণের সুযোগ করে দিতে হবে।