বিদেশে নয়, দেশের ভেতরেই সমস্যার সমাধান করতে হবে: আমীর খসরু
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্দেশ্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, বাংলাদেশের সমস্যা বাংলাদেশের মাটিতেই সমাধান করতে হবে। দেশের বাইরে গিয়ে বেশি কথা না বলে দেশের ভেতরেই বলা উচিত। কারণ সমস্যার সমাধান দেশের মানুষের হাতেই। কোনো বাইরের শক্তির কাছে এর সমাধান নেই। সংস্কার, বিচার সব কিছুর সমাধান একটাই, তা হলো বাংলাদেশের জনগণ। সমাধান দেওয়ার আর কেউ নেই। সমাধান দেওয়ার দ্বিতীয় কোনো অস্ত্র নেই। মাত্র একটাই অস্ত্র, সেটা জনগণ।
আজ শুক্রবার বিকালে নগরীর মুরাদপুরস্থ এলজিইডি ভবন মিলনায়তনে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৪৪ তম শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির স্মরণ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহবায়ক এরশাদ উল্লাহর সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব নাজিমুর রহমানের পরিচালনায় সভায় প্রধান আলোচক ছিলেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এস এম আবদুল আউয়াল। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম।
নির্বাচিত সরকার ছাড়া জনগণের প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব নয় জানিয়ে আমীর খসরু বলেন, আমরা নির্বাচনের অপেক্ষায় আছি। কারণ, একটি নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব নয়। অনির্বাচিত সরকারের পক্ষে এসব বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। জনগণের সমর্থনব্যতীত কোনো কিছুই সম্ভব না।
আমীর খসরু বলেন, তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে একটা নির্বাচিত সরকারের প্রয়োজন। এটা কোনো দল চায় কি চায় না, সেটাই মুখ্য নয়, বাংলাদেশের মানুষ আজ গণতন্ত্রের জন্য অপেক্ষা করছে, প্রত্যাশা করছে।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে জর্জ ওয়াশিংটনের সঙ্গে তুলনা করে আমীর খসরু বলেন, বিশ্বের অল্প কয়েকজন ব্যক্তিত্বের মধ্যে মধ্যে জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন। জিয়াউর রহমান প্রথমে একটি দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। একটি দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে যে সাহস, সে দূরদর্শিতা, যে ঝুঁকি একজন লিডার নেন, সেটা একটা বিশাল ব্যাপার। দ্বিতীয়ত হচ্ছে তিনি একজন বিশ্বমানের সংস্কারক, একজন রাজনীতিবিদ, উনি একজন দার্শনিক, একজন সমাজ গড়ার কারিগর। উনি বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় দিয়েছেন, একটি জাতির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দিয়েছেন, জাতির দিকদর্শন দিয়েছেন। সবকিছুর সমন্বয়ে চিন্তা করলে দেখা যাবে এই মানের বিশ্বে মাত্র কয়েকজন মানুষ রয়েছেন। এদের মধ্যে একজন জর্জ ওয়াশিংটন। বাংলাদেশের কারও সঙ্গে জিয়াউর রহমানের তুলনা করার প্রয়োজন নেই। আগামী দিনের জন্য মেধাভিত্তিক রাজনীতির মাধ্যমে আগামী দিনের জন্য নেতাকর্মীদের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আমির খসরু বলেন, আমাদের বিরূদ্ধে যারা আছে তাদের পরাজিত করতে হলে মেধাভিত্তিক রাজনীতি করতে হবে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
বিএনপির এই নেতা বলেন, একটি সরকার মানে শুধু মন্ত্রী, এমপি, পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তা, সামরিক বাহিনী নয়। একটি সরকারের মেরুদণ্ড হচ্ছে দেশের জনগণ। এই জনগণের শক্তির ওপর ভিত্তি করেই চলে সরকার।
বিএনপিকে দেশপ্রেমিক দল আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, এই দলটি দেশপ্রেমের ওপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশকে গড়ার জন্য এই দলের সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিএনপি সৃষ্টি হয়েছে। এটি সবার মধ্যে ধারণ করতে হবে।
আমীর খসরু বলেন, একটি দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে সংস্কৃতি সবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমাদের সংস্কৃতির জায়গাটি অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ‘ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রি’ নামক একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। এতে নাটক, সংগীত, চিত্রশিল্প, কামার-কুমার, তাতি যারা সংস্কৃতিভিত্তিক কাজ করেন, তাদের একটি বিশাল অর্থনৈতিক পরিসরে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। বাইরের সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেতে হলে নিজেদের সংস্কৃতিকেই এগিয়ে আনতে হবে।
ক্ষমতায় গেলে দেশীয় সংস্কৃতি ও সৃজনশীল অর্থনীতিকে মূলধারায় আনার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হবে জানিয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, সংস্কৃতি একটি দেশের অস্তিত্ব ও আত্মপরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ খাতকে অবহেলা করে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
দেশ পরিচালনার প্রস্তুতি নিয়ে তিনি বলেন, বিএনপি এখন যে প্রস্তুতি নিচ্ছে, তা অত্যন্ত পরিকল্পিত। জনগণ যদি আমাদের নির্বাচিত করে, তাহলে আমরা প্রথম দিন থেকেই কাজ শুরু করতে পারব। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে আমরা নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি। এই পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে শহীদ জিয়াউর রহমানের দর্শন।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
ঢাকার তারুণ্যের সমাবেশের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, লাখো মানুষের অংশগ্রহণে এমন ভিড় হয়েছিল যে আমাকে রিকশায় যেতে হয়েছিল, পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। এটা প্রমাণ করে আমাদের নেতাকর্মীরা এখনও উদ্দীপ্ত। এই স্পিরিট আমাদের ধরে রাখতে হবে। দেশকে যদি জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের চিন্তাধারায় গড়তে চাই, তাহলে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কোনো দ্বিধা নয়, সকলকে একসাথে কাজ করতে হবে।
প্রধান বক্তার বক্তব্যে ড. এস এম আবদুল আউয়াল বলেন, ২৫ মার্চের সেই কালোরাত্রিতে জাতি যখন দিশেহারা তখনই নেতৃত্বশূণ্য জাতিকে মুক্তি দিতে এগিয়ে এসেছিলেন শহীদ জিয়াউর রহমান। চট্টগ্রামের ষোলশহর বিপ্লব উদ্যান থেকে তিনি পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেন। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে তিনি চুপ করে বসে ছিলেন না। তিনি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন আবার অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের মাঠে থেকে দেশকে স্বাধীন করেছেন। স্বাধীনতার পরের সরকারের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা থেকে দেশকে বের করে নিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। খাদ্যশস্যের উৎপাদন দিগুণ করেছিলেন। নতুন কুড়ির মাধ্যমে শিশুদের মননের বিকাশ ঘটিয়েছেন। চিকিৎসা ক্ষেত্রে অনবদ্য অবদান ছিল শহীদ জিয়ার। তিনি আওয়ামী লীগের তলা বিহীন জুড়ি থেকে দেশকে স্বনির্ভর বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা ইতিহাসের অংশ।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মাহবুবের রহমান শামীম বলেন, শহীদ জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন বলেই আমরা একটি বাংলাদেশ পেয়েছি। তিনি বাকশালী দুঃশাসন থেকে জাতিকে মুক্ত করে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।এখন পর্যন্ত দেশের যে মৌলিক উন্নয়নগুলি হয়েছে তার ভিত্তি শহীদ জিয়া গড়েছিলেন। বিএনপি দীর্ঘ সতের বছর একটি ভোটবিহীন স্বৈরাচারর শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে এখনও মাঠে ঠিকে আছে। যদি আবার কোন নতুন ষড়যন্ত্র দেখতে পায় তাহলে জনগণকে সাথে নিয়ে রাজপথেই অবস্থান নিবে বিএনপি। ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। তা নাহলে জনগণ রাস্তায় নামবে। বাংলাদেশে আন্দোলনের সুনামী বয়ে যাবে।
সভাপতির বক্তব্যে এরশাদ উল্লাহ বলেন, শহীদ জিয়া ছিলেন একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ। তার সততা ও দেশপ্রেমের ব্যাপারে তার শত্রুরাও প্রশ্ন তুলতে পারেনি। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণা এবং সম্মুখ সমরে তাঁর বীরোচিত অংশগ্রহণ জাতিকে স্বাধীনতা অর্জনে অনুপ্রাণিত করেছিল। তাঁর শাসনামলে দেশে অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ দেশের আপামর জনসাধারণকে এক নতুন পরিচয়ে পরিচিত করেছিল।
এ এম নাজিম উদ্দীন বলেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। স্বাধীনতা উত্তর দুর্ভিক্ষ পীড়িত জনগণ যখন হতাশা আর অনিশ্চয়তায় নিমজ্জিত ঠিক তখনি শহীদ জিয়ার আবির্ভাব ঘটেছিল ধুমকেতুর মত। তিনি ছিলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা।
আবুল হাশেম বক্কর বলেন, দেশের সংকটময় মুহূর্তে ত্রাণ কর্তা হিসেবে শহীদ জিয়া বার বার দেশকে মুক্ত করেছেন। তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন আবার অস্ত্রহাতে যুদ্ধও করেছেন। তিনি ছিলেন জেড ফোর্সের অধিনায়ক ও দুটি সেক্টরের কমান্ডার। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শহীদ জিয়ার অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে।
নাজিমুর রহমান বলেন, স্বাধীনতার ঘোষণা এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রথম বিদ্রোহ চট্টগ্রাম থেকেই হয়েছে। শহীদ জিয়া কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে নীরব ছিলেন না। এদেশের সেনাবাহিনীকে সংগঠিত করে তিনি পাক সেনাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেছেন চট্টগ্রাম থেকেই। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ জিয়ার অবদান মানুষের হৃদয়ে।
স্বরণ সভায় বক্তব্য রাখেন বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির শ্রম সম্পাদক এ এম নাজিম উদ্দীন, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার, চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্ট অ্যসোসিয়েশনের সভাপতি এস এম সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের সাবেক সভাপতি মোশাররফ হোসেন দিপ্তী, মহিলাদলের সভাপতি মনোয়ারা বেগম মনি, স্বেচ্ছাসেবক দলের আহবায়ক বেলায়েত হোসেন বুলু, ছাত্রদলের আহবায়ক সাইফুল আলম।