দুই জুন রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারে বাজেট উপস্থাপন
গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পরিবর্তনের ফলে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের ভিন্ন বাস্তবতায় এবার ভিন্ন আঙ্গিকে সংসদের বাইরে বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। ২ জুন বিকাল ৪টায় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাজেট উপস্থান করবেন। সংসদ না থাকায় ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্য এবার রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম বিটিভিসহ অন্যান্য বেসরকারি গণমাধ্যমে একযোগে প্রচার করা হবে।
এর আগে সংসদের বাইরে বাজেট দেওয়া হয়েছিল ২০০৮ সালে। তখন ক্ষমতায় ছিল সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সংসদ কার্যকর না থাকায় এবারও সংসদের বাইরে বাজেট দিতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে রীতি অনুসারে বাজেট পেশের পরের দিন ৩ জুন সংবাদ সম্মেলন করবেন অর্থ উপদেষ্টা। আর রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাজেট অনুমোদিত হবে। খবর অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রের।
জানা গেছে, নতুন বাজেটে অগ্রাধিকার পাবে খাদ্য নিরাপত্তা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থসামাজিক উন্নয়ন। গুরুত্ব পাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর স্বার্থ। এর অংশ হিসেবে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা ও ভাতার পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম আগের বছরের তুলনায় নতুন বাজেটের আকার ছোট হচ্ছে। মূলত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকুচিত মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বয় করে সরকারি ব্যয় কমানো এবং বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য করতেই আকার কমানো হচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, বাজেটের আকার কমানো হলেও সমাজে বৈষম্য কমানোর পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির চাপে নিম্ন আয়ের মানুষদের স্বস্তি দিতে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে উপকারভোগী ও কিছু ক্ষেত্রে ভাতার পরিমাণ বাড়ানোর উদ্যোগ থাকছে নতুন অর্থবছরের বাজেটে। একই সঙ্গে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
আগামী অর্থবছরের জন্য জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে সাড়ে ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অবশ্য বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং এডিবির পূর্বাভাস হলো, এবার প্রবৃদ্ধি এর চেয়ে অনেক কম হবে।
জানা গেছে, গত ৯ মাসেই নতুন করে ২৭ লাখ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমেছে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এ ছাড়া রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে অনেক কল-কারখানা, দোকান-পাট, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে। এ জন্য ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাজেটের আকার ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির টার্গেট কমিয়ে ধরা হচ্ছে। সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে। এ ছাড়া কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা খাতকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, আর্থিক সংকট এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ক্রমবর্ধমান চাপের কারণে ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সারাদেশের শিল্পখাত ব্যাপক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাজেট বাস্তবায়নের ওপর। কেননা ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে না পারলে কর দেবেন কোথা থেকে- এ প্রশ্ন রেখেছেন ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান।
তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছেন। একদিকে ভ্যাট-ট্যাক্সের চাপ, অন্যদিকে মামলা-মোকদ্দমার আতঙ্ক। গ্যাস-বিদ্যুতের পুরনো সংকট তো আছেই। আবার কর্মীদের বেতন-ভাতা দিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জে আমরা দিশেহারা হয়ে পড়েছি।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
সূত্র জানায়, এনবিআরকে বিলুপ্ত ঘোষণার প্রতিবাদে কর্মীদের আন্দোলনে অচল হয়ে পড়েছে রাজস্ব খাত। এদিকে অর্থবছর (২০২৪-২৫) শেষে রাজস্ব ঘাটতি ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কা করা হচ্ছে। এ ছাড়া জারি করা সরকারি চাকরি বিধির নতুন অধ্যাদেশ নিয়ে যে অচলবস্থা তৈরি হয়েছে, সেটা দীর্ঘায়িত হলে আরও চাপে পড়বে অন্তর্বর্তী সরকার। এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার।
অবশ্য ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যে এবার বাজেটের আকার কমিয়ে ধরা হচ্ছে। যা ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার মধ্যেই থাকবে বলে জানিয়েছেন ড. সালেহউদ্দিন। যেখানে চলতি বছরের বাজেটের আকারই ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এসব অস্থিরতা আর সমস্যার মধ্যে জনগণকে ২ জুন কতটা স্বস্তি দিতে পারবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ- এমন প্রশ্নে তিনি বলেছেন, সত্যিকার অর্থে সমতা ও জনকল্যাণকর বাজেট আমরা দেব। যার উপকারভোগী হবে দেশের ১৮ কোটি মানুষ।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে যতটুকু অর্থায়ন করতে পারবে ঠিক ততটুকু বাজেট দেওয়া। আমি অর্থ উপদেষ্টাকে বলব, আপনি যেটা অর্থায়ন করতে পারবেন না সেটা বলবেন না। সেই বাজেট আপনি করবেন কেন যে বাজেট আপনি অর্থায়ন করতে পারবেন না।
এদিকে অর্থনীতির সবচেয়ে অস্বস্তিকর সূচক মূল্যস্ফীতির চাপ সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার টার্গেট করছে সরকার। যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা সম্ভব নয়। এ ছাড়া নির্বাচনী ডামাডোল ও রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং এনবিআরকে বিলুপ্ত করার প্রতিবাদে চলমান আন্দোলনে রাজস্ব আদায়ে ভাটা পড়েছে। ফলে নতুন বছরে রাজস্ব খাত আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে।
অর্থবিভাগের একটি সূত্র জানায়, এমনিতেই নির্বাচনী চাপ নিয়ে সরকারের ভেতরে-বাইরে রয়েছে অস্থিরতা। সময় গড়ানোর সঙ্গে-সঙ্গে বাড়ছে সেই চাপ। আসন্ন বাজেটে জাতীয় নির্বাচনের জন্য পৃথকভাবে তহবিল বরাদ্দও রাখা হচ্ছে। আবার সরকারি কর্মচারীদের জন্য ঘোষিত মহার্ঘ ভাতা ১ জুলাই থেকে বাস্তবায়ন করতে হলে অতিরিক্ত ৭ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে; যা বাজেটে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। প্রবাসীরা বেশি করে রেমিট্যান্স পাঠানোয় রিজার্ভ বাড়ছে। রপ্তানি খাতেও কিছুটা প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে বেকার এবং দারিদ্র্যের হার বাড়ায় আবার ভারসাম্যহীন হয়ে পড়তে পারে সামষ্টিক অর্থনীতি- এমনই মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, গত পাঁচ বছরে এতটা অস্থির আর সংকট নিয়ে বাজেট প্রণয়ন করতে হয়নি। একে তো বিশেষ ধরনের সরকার, আবার এই সরকারের ভেতরে ও বাইরে নানা রকমের অস্থিরতাও রয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ ছাড়া বহির্বিশ্বের সঙ্গেও নানা রকমের তিক্ততা তৈরি হয়েছে। ফলে এবারের বাজেটটা কঠিন এক চ্যালেঞ্জিং সময়ে ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থ উপদেষ্টা।