অধিকাংশ দলই নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চায়

শাহজাহান মোল্লা
২৬ মে ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
অধিকাংশ দলই নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চায়

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করার কথা ভাবছেন- সম্প্রতি দেশজুড়ে এমন আলোচনার মধ্যে গতকাল রবিবার ও এর আগের দিন শনিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও জামায়াতসহ অন্তত ২০টি রাজনৈতিক দলের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল। বৈঠকে প্রতিটি দলই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে এবং সংস্কার ও জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে তাদের অবস্থান তুলে ধরেছে। অধিকাংশ দলের পক্ষ থেকেই প্রধান উপদেষ্টাকে জানানো হয়েছে, সংস্কারের পাশাপাশি আগামী জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চান তারা।

এদিকে গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের পর সাংবাদিকদের উদ্দেশে ব্রিফ করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। এ সময় তিনি বলেন, দলগুলো প্রধান উপদেষ্টার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে আবারও বলা হয়েছে- নির্বাচন ৩০ জুনের ওপারে যাবে না। এতে বিভিন্ন দলের নেতারা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

প্রেস সচিব বলেন, পার্টির লিডাররা প্রফেসর ইউনূসকে সমর্থন জানিয়েছেন। আমরা যে সংস্কার করছি, আমরা যে বিচারকাজ শুরু করেছি, নির্বাচনের কার্যক্রম শুরু করেছি, সেটাতে তারা সম্পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও প্রধান উপদেষ্টার পাশে থাকবেন।

শফিকুল আলম জানান, দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচন, সংস্কারসহ আরও অনেক বিষয়ে কথা হয়েছে।

গত শনিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি। গতকাল বৈঠক করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সেক্রেটারি সাইফুল হক, জাতীয় গণফ্রন্টের সমন্বয়কারী টিপু বিশ্বাস, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান মঞ্জু, ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমেদ আবদুল কাদের, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির জাতীয় নির্বাহী পরিষদের মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইজহার ও ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজি।

প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ ভাবনায় রাজনৈতিক অঙ্গনে যে সংকট দেখা দিয়েছিল, গত দুদিনের বৈঠকে তা অনেকটাই কেটে গেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা ও বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, পরিস্থিতির আরও উন্নতি ঘটাতে হলে নির্বাচন ইস্যুতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অবস্থান জনগণের সামনে পরিষ্কার করতে হবে।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক ড. মাহবুবউল্লাহ আমাদের সময়কে বলেন, রাজনীতিতে বাদানুবাদ থাকবে, মতপার্থক্য থাকবে, তর্ক-বিতর্ক থাকবে। আশা করা যাচ্ছে, এ অভিজ্ঞতা থেকে দেশ একটা স্থিতিশীলতার দিকে যাবে।

বিএনপি দাবি করছে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে। এ বিষয়ে সরকার আগের অবস্থানেই রয়েছে। সরকার ও বিএনপির এমন ভিন্ন অবস্থানের জেরে রাজনীতিতে কোনো অস্থিরতা দেখছেন কি? এমন প্রশ্নে ড. মাহবুবউল্লাহ বলেন, নির্বাচন নিয়ে সরকার কীভাবে কি চিন্তাভাবনা করছে, আর বিএনপি কি ভাবছে- এটা তারাই ভালো বলতে পারবে। দুই পক্ষ আলাপ-আলোচনা করেই হয়তো একটা সমাধানে আসবে। এ জন্য সরকারের উচিত তার অবস্থান পরিষ্কার করা।

এনসিপি বলছে, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই ইসি পুনর্গঠনের দাবি জানিয়েছে দলটি। পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিও তোলা হয়েছে এনসিপির তরফে। তাদের দাবি অনুযায়ী এ সময়কালের মধ্যে ইসি পুনর্গঠন সম্ভব কি? এক্ষেত্রে আইন কি বলে? এমন প্রশ্নে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়–য়া আমাদের সময়কে বলেন, এটা রাজনৈতিক দাবি। আইনি সংস্কার না করে ইসি পুনর্গঠনের সুযোগ এ মুহূর্তে নেই। যে আইন আছে, সেই আইনের ওপর পর্যবেক্ষণ দিয়েছে সংস্কার কমিশন। সংস্কার কমিশনের সেই রিপোর্ট নিয়ে কাজ করছে ঐকমত্য কমিশন। ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত হওয়ার পর সবার মতামত নিয়ে আইনের কোথায় কি পরিবর্তন করবে, সেটা রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত। সেটা না হওয়া পর্যন্ত পুনর্গঠন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, যা-ই হোক, আইন অনুযায়ী হতে হবে। এর বাইরে কিছু করার নাই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারাও মনে করেন নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করলে সব ভেদাভেদ ভুলে দলগুলো নির্বাচনমুখী হবে। প্রধান উপদেষ্টার সাথে বৈঠক শেষে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, বৈঠকে বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়েছি। তিনি বলেন, সরকারের নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে। উপদেষ্টারা একেক সময় একেক কথা বলছেন। প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করলে রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে। বৈঠকে তাদের দলের পক্ষ থেকে করিডর ও বন্দরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত না নিতে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। আমরা শুধু চাই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। দেখতে হবে, কোন সংস্কারটা না করলেই নয়। সংস্কারের ক্ষেত্রে যদি সময়ক্ষেপণ হয়, তবে নির্বাচনে বিলম্ব হবে। কিন্তু তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে, এপ্রিলের পর কোনোভাবেই আর সময় গড়াবে না।

আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, আমরা মনে করি ৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন হতে পারে। সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারে বলেও প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, প্রশাসন তার নিয়ন্ত্রণে এলেই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন।

মামুনুল হক বলেন, হেফাজতে ইসলামের মামলাগুলো প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছি। গত ৩ মে মামলা প্রত্যাহারে দুই মাসের আল্টিমেটাম দিয়েছিলাম। প্রধান উপদেষ্টা আশ্বস্ত করেছেন যে, মামলাগুলোর বিহিত করবেন; বিষয়টি নিজেই দেখবেন। নারী সংস্কার কমিশনের বিষয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছি। সরকার আমাদের কথা ইতিবাচকভাবে নিয়েছে। তারা কোরআন-সুন্নাহবিরোধী আইন বাস্তবায়ন করবেন না বলে আশ্বস্ত করেছেন।

গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নুর বলেন, যেসব উপদেষ্টাকে নিয়ে বিতর্ক রয়েছে তাদের অপসারণের কথা বলেছি। বিএনপিও দাবি করেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়রের শপথ এবং উত্তরের প্রশাসককে নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, আমরা এতে উদ্বেগ জানিয়েছি। সরকার ও জনগণকে এবং সামরিক বাহিনীকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার যোগাযোগ বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছি। তিনি ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন। বন্দর ও করিডর দেওয়ার সিদ্ধান্ত না নেওয়ার কথা বলেছি। নির্বাচন কবে হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট মাসের ঘোষণা দিতে বলেছি। নির্বাচন ছাড়া দেশে কোনো সংকটের সমাধান হবে না, প্রধান উপদেষ্টাকে এ কথা বলেছেন বলে জানান নুর।