`আমার চোখ আমার আলো' প্রকল্পে চরফ্যাশনের ১০ হাজার মানুষের চোখের চিকিৎসা

অনলাইন ডেস্ক
১৯ মে ২০২৫, ১৯:৩৯
শেয়ার :
`আমার চোখ আমার আলো' প্রকল্পে চরফ্যাশনের ১০ হাজার মানুষের চোখের চিকিৎসা

পৃথিবীতে চোখ নিয়ে কত কবি লিখেছেন কত গান , কত কবিতা। প্রেয়সীর চোখে নিজেকে হারায় কতশত প্রেমিক। এই চোখেই আমরা দেখি ঈশ্বরের সব অপরূপ সৃষ্টি । আবার কষ্ট পেলে অশ্রু ঝড়াই এই চোখ দিয়েই, হালকা করি নিজেকে। এই যে চোখ নিয়ে এত কথা লিখছি আমার চোখে যদি আলো না থাকতো ! কিভাবে লিখতাম আমি ?

 এই চোখের মূল্য ভালো করে টের পেলাম গত এপ্রিলে চরফ্যাশনের শশীভূষন মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে। নিজের কিছু কাজে যাই সেখানে। ভিতরে ঢুকে দেখি সেখানে চলছে “আমার চোখ আমার আলো” নামে বিনামূল্যে চক্ষুসেবার একটি প্রকল্প। প্রায় একশজন রোগী সিরিয়াল দিয়ে বসে আছে। তাদের মধ্যে কারো আজ চোখের ছানি অপারেশন হবে, অনেকে এসেছেন অপারেশনের পরে সেলাই খুলতে আবার কেউ এসেছেন ফলোআপে। হঠাৎ চোখ গেল এক বৃদ্ধ দম্পতির দিকে।

একজন বয়স্ক নারী কালো বোরখা পড়া তবে মুখের নেকাব খোলা। নাকে খুব সুন্দর নাকফুল। চোখে কালো চশমা। কিন্তু গাল বেয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝড়ছে। তার হাত ধরে বসে আছেন আরেকজন বৃদ্ধ। কৌতুহল সামলাতে না পেরে কাছে গেলাম। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক করার জন্য কথা বলা শুরু করলাম আঞ্চলিক ভাষায়। জোরে বললাম, ও কাকি! কান্দেন কিয়ারে? কিয়িছে আমনের? তিনি যেন এক ঝটকায় আপন করে নিলেন আমাকে। শোনালেন তার আনন্দাশ্রুর গল্প।

মনোয়ারা বেগমের বিয়ে হয় ১৫ বছর বয়সে। স্বামী সবুর আলী গ্রামে চাষাবাদের কাজ করতেন। দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে তাদের পাঁচ মেয়ে। সবাইকে বিয়ে দিয়ে সংসারি করেছেন। মেয়েরা টুকটাক খোঁজখবর নিলেও সেভাবে দায়িত্ব নেয়নি বাবা-মায়ের। কথায় বলে, মেয়ের শ্বশুড় বাড়িতে বাবা-মায়ের থাকতে নেই। তাই আত্মসম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে মনোয়ারা-সবুরও যাননি কোন মেয়ের কাছেই। বয়স বাড়ার সাথে সাথে নিয়ম করে বাড়ে শারীরিক জটিলতা। আস্তে আস্তে চোখে কম দেখা শুরু করেন মনোয়ারা। অভাবের সংসারে যেখানে দিন আনতে পান্তা ফুরায় সেখানে সামান্য চোখে কম দেখার জন্য ডাক্তার দেখানো যেন বিলাসিতা। দিন যতই বাড়ে মনোয়ারা বেগমের চোখের আলো তত কমে। গত একবছরে দেখেননি পৃথিবীর কোন রঙ। দেখেননি শেষজীবনের একমাত্র ভরসা, ভালবাসা, স্বামী সবুর আলীকে। মনোয়ারার হাটাচলার সুবিধার জন্য সবুর মিয়া বাড়িতে, চলার পথে এমনভাবে দড়ি বেঁধে পথ তৈরি করে দিয়েছেন যেন সেই দড়ি ধরে ধরে মনোয়ারা বেগম নিজের কিছু কাজ একা করতে পারেন, একা পায়চারি করতে পারেন নিজের চিরচেনা উঠানে। আমার চোখ আমার আলো প্রকল্পের ভলেন্টিয়ারদের সহযোগিতায় এখানে এসেছেন তিনি । চিকিৎসার সব ধাপ পার করে আজ চোখের সেলাই খুলেছে মনোয়ারার। দুচোখে মন ভরে দেখছেন স¦ামীকে। একবছরে নাকি বুড়িয়ে গেছেন তার প্রিয় মানুষটি। আজই নাকি রান্না করবেন স্বামীর প্রিয় কলার মোচা, টেংরা মাছের ঝোল, আরো কত কী! এখন থেকে একাই গোসল করতে যাবেন খালে। এতদিন যে হিজলের শুধু ঘ্রান পেয়েছেন আজ থেকে তা দুচোখ ভরে দেখবেন। খুশিতে তিনি কখনো কাঁদছেন কখনো হাসছেন। এরকম দৃশ্য নিজের চোখে দেখাও যেন স্বর্গীয় অনুভূতি।

জানুয়ারি থেকে প্রায় ১০ হাজার মানুষকে বিনামূল্যে চক্ষু চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে ‘অমার চোখ আমার আলো’ প্রকল্প। বিনামূল্যে ছানি অপারেশন হয়েছে প্রায় ৩ হাজার মানুষের। উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হচ্ছে বিভিন্ন নামকরা হাসপাতালে। রয়েছে বিদেশেও উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা। মনোয়ারার মত হাজার হাজার মানুষ আজ নিজের চোখে দেখছেন ভোরের আলো, হিজলের বন, কৃষ্ণচূড়ার রঙ। কথায় বলে , ঈশ্বর কিছু সময় নিজের দূত পাঠান দূর্গতদের সাহায্য করতে। চরফ্যাশনের মানুষের জীবনে আজ তেমনই ঈশ্বরের দূত হয়ে হাজির হয়েছে আমার চোখ আমার আলো প্রকল্প। দেশের প্রতিটি আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ুক ‘আমার চোখ আমার আলো’