লবলং খালের টুঁটি চেপে ধরেছে ১১ শিল্পকারখানা
গাজীপুরের শ্রীপুরের ‘ফুসফুস’খ্যাত লবলং খালের টুঁটি চেপে ধরেছে ১১ শিল্পকারখানা। এসব কারখানার দূষণে খালটির অবস্থা মৃতপ্রায়। এক বছর আগে স্থানীয় প্রশাসন এসব শিল্পকারখানার কাছ থেকে খালের জমি উচ্ছেদ প্রস্তাব দেওয়া হলেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। খালের প্রায় দুই একর জমি অবৈধভাবে দখল করে গড়ে উঠেছে শিল্পকারখানাগুলো, যার বাজারমূল্য কয়েক কোটি টাকা।
স্থানীয়রা জানান, শ্রীপুর পৌর এলাকার এক্স সিরামিকস কারখানার বিরুদ্ধে পরিবেশ ও সরকারি সম্পদ রক্ষায় একের পর এক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। শ্রীপুরের কেওয়া ও রাথুরা মৌজার বিস্তীর্ণ অংশজুড়ে খালটি দখল করে এক্স সিরামিকস কারখানা। এতে খালের ওই অংশ সংকুচিত হয়ে যায়। একই সঙ্গে কারখানা থেকে নির্গত রাসায়নিক বর্জ্য খালে ফেলার কারণে দূষিত হচ্ছে পানি। এ কারণে খালের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হওয়ায় জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে ফসলি জমিতে। এ কারখানা ৩৩ শতাংশ জমি অবৈধভাবে দখল করে খালের গতিপথ পরিবর্তন করে ফেলেছে।
ঢাকা বন বিভাগের শ্রীপুর রেঞ্জ সূত্রে জানা গেছে, শ্রীপুর সদর বিটের অধীন কেওয়া মৌজার (সিএস/এসএ দাগ নং ১১০৭ ও আরএস দাগ নং ১০০৭২১০০৭৮ পর্যন্ত) জমি সরকার ঘোষিত সংরক্ষিত বনভূমি। কারখানাটি এই জমি বৈধভাবে দখল করে রেখেছে। বিষয়টি নিয়ে ২০২৫ সালের ৬ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানটিকে নোটিশ পাঠানো হয়। শ্রীপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মোকলেছুর রহমান বলেন, বনের জমি উদ্ধারে আমরা প্রক্রিয়া শুরু করেছি। চলতি বর্ষায় এ জমিতে বনায়নের মাধ্যমে দখলমুক্ত করা হবে। তবে এক্স সিরামিকস কারখানার প্রশাসনিক কর্মকর্তা আল মামুন চৌধুরী বলেন, বন বিভাগের কোনো নোটিশ পেয়েছি কিনা তা নিশ্চিত নই। তবে খালসংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন দপ্তরের ডাকে আমরা সাড়া দিয়ে জবাব দিয়েছি।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রমতে, ১১ শিল্পকারখানা খালটির জমি দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করেছে। এর মধ্যে মাওনা মৌজার নোমান গ্রুপ ও স্বাদ গ্রুপের নাইস স্পান ১৯ শতাংশ, নাইস মাইক্রোফ্যাব ৪ শতাংশ, জাবরা টেক্সটাইল ও নাইস ফেব্রিকস ৩ শতাংশ, ইসমাইল টেক্সটাইল ও স্বাদ টেক্সটাইল ২০ শতাংশ জমি দখল করেছে। এ ছাড়া সরকারি অনুমতি ছাড়াই কারখানাগুলোর পক্ষ থেকে খালের ওপর ব্রিজও নির্মাণ করা হয়েছে। এদিকে পৌর এলাকার পারফেট্রি ভ্যান কারখানা ৩৩ শতাংশ, ভিনটেজ ডেনিম অ্যাপারেলস ১০ শতাংশ, ব্লু প্ল্যানেট ২৭ শতাংশ, নর্দান ক্লোথিং লিমিটেড ২৩ শতাংশ, বেঙ্গল গ্রেনাইড অ্যান্ড মার্বেল লিমিটেড
১৬ শতাংশ, ডেকো গার্মেন্টস ৬ শতাংশ খালের জমি দখল করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের রাসায়নিক মিশ্রিত পানি ট্রিটমেন্ট ছাড়া খালে প্রবাহিত করায় দূষণেও সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।
বেরাইদের চালা গ্রামের কৃষক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, কারখানার কারণে খালের পানি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে আমাদের জমিতে নিয়মিত জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ‘শ্রীপুর উপজেলা নদী পরিব্রাজক দল’র সাধারণ সম্পাদক শাফি কামাল বলেন, এক্স সিরামিকসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ক্ষমতার অপব্যবহার করে খালটির টুঁটি চেপে ধরেছে। আমরা বারবার আন্দোলন করেও কাক্সিক্ষত ফল পাইনি। বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মনির হোসেন বলেন, দখল আর দূষণে চরম সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে লবলং খালটি। ইতিপূর্বে পরিবেশ আইন সমিতির (বেলা) পক্ষ থেকে রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে খালটি দখল ও দূষণমুক্ত করতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। যার বাস্তবায়ন দেখতে পাইনি। যেভাবেই হোক খালটি উদ্ধার করতে হবে।
শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ব্যারিস্টার সজীব আহমেদ বলেন, প্রায় এক বছর আগে ১১টি অবৈধ দখলদার প্রতিষ্ঠানের উচ্ছেদ প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে, যার মধ্যে এক্স সিরামিকসও রয়েছে। খাল রক্ষায় সব সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আরেফিন বাদল বলেন, খাল দখলমুক্ত করতে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। পরিবেশগত ক্ষতি হলে প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে গাজীপুরের জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো বক্তব্য না দিয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি, রাজস্ব) মোহাম্মদ কাইসার খসরুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। পরে এডিসি বলেন, উচ্ছেদের পরিকল্পনা আমাদের আছে। তবে কবে নাগাদ হবে তা বলা যাচ্ছে না।