আবু সাঈদ হত্যা /
বেরোবি শিক্ষকসহ ৭১ জনের বিরুদ্ধে মামলা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) সহিংসতার ঘটনায় দুই শিক্ষকসহ ৭১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। দীর্ঘ আট মাস পর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার হারুন অর রশিদ বাদী হয়ে গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে নগরের তাজহাট থানায় মামলাটি করেন।
মামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী ৩৫ জন, শিক্ষক ২, কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৩, পুলিশ কর্মকর্তা ও কনস্টেবল ৮ জন, স্থানীয় ছাত্রলীগ-যুবলীগের ১৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া আরও ৮০-১০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।
আজ বুধবার তাজহাট থানায় বিস্ফোরক আইনে মামলা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. হারুন অর রশীদ। এরপর সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেট থেকে সহকারী রেজিস্ট্রার মোক্তারুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ২০২৪ সালের ১১, ১৫ ও ১৬ জুলাই দুপুর ২টায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটের সামনে ও সংলগ্ন মহাসড়কে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছিলেন। এসময় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মী ও সন্ত্রাসীরা লাঠি, লোহার রড, ছোরা, রামদা, কিরিচ, ইটপাটকেল, বোমা, পিস্তল নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে।
এছাড়া পুলিশ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ছররা গুলি ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। এতে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ শহীদ হন এবং অনেক শিক্ষার্থী আহত হন।
আসামিদের তালিকায় রয়েছেন- বেরোবি ছাত্রলীগ সভাপতি পোমেল বড়ুয়া (৩০), সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান শামিম (২৭), যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদুল হাসান, দপ্তর সম্পাদক বাবুল হোসেন (২৭), সাংগঠনিক সম্পাদক ধনঞ্জয় কুমার দাস ওরফে টগর (২৮), সহ-সভাপতি বিধান বর্মণ (২৭) সহ-সভাপতি গ্লোরিয়াস ফজলে রাব্বী (২৭)।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
ছাত্রলীগ নেতা তানভির আহমেদ তানভির (২৭), যুগ্ম সম্পাদক শাহিদ হাসান সিদ (২৮), সহ-সভাপতি মমিনুল হক (২৭), সহ-সভাপতি আখতার হোসেন (২৭), সহ-সভাপতি মো. শাহীন ইসলাম (২৯), প্রচার সম্পাদক সাব্বির হোসেন ওরফে রিয়ান (২৫), সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন (২৬), মৃত্যুঞ্জয় রায় (২৩), উপ-প্রচার সম্পাদক মোশাররফ হোসেন (২৩), সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহ আল নোমান (২৫), উপ-সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক মো. রিফাত হোসেন (২৫), ফরহাদ হোসেন এলিট (২৬), আবির শাহরিয়ার অনিক (২৫), উদ্যোক্তা ও উদ্ভাবন বিষয়ক সম্পাদক আরিফুজ্জামান ইমন (২৭)।
ছাত্রলীগের মাদরাসা বিষয়ক সম্পাদক গাজিউর রহমান (২২), ইমরান চৌধুরী আকাশ (২৮), যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। সেজান আহম্মেদ ওরফে আরিফ (২৬), সাংগঠনিক সম্পাদক। আরাফাত রহমান আবির (২৪), পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক। শোয়াইবুল ইসলাম ওরফে সাল্লু (২৫), উপ-স্কুল বিষয়ক সম্পাদক। আব্দুল্লাহ আল রায়হান (২৫), সামাজিক যোগাযোগ বিষয়ক সম্পাদক। অমিত হাসান ওরফে অমিত (২২), গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক। মাহমুদুর রহমান হৃদয় (২৩), উপ-অটিজম বিষয়ক সম্পাদক। পিপাস আলী (২৫), সাংগঠনিক সম্পাদক। মানিক চন্দ্র সেন (২৪), উপ-ক্রীড়া সম্পাদক।
আরিফ হোসেন (২৪), ছাত্রলীগ নেতা। সিয়াম আরাফাত (২৩), ক্রীড়া সম্পাদক। নাফিউল ইসলাম (২২), ছাত্রলীগ কর্মী। আবু সালেহ নাহিদ (২৫), ছাত্রলীগ কর্মী। বায়োজিদ মোস্তাফি (২৭), ছাত্রলীগ কর্মী।
মশিউর রহমান, সহকারী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ। আসাদুজ্জামান মন্ডল আসাদ (৪০), সহযোগী অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ। হাফিজুর রহমান তুফান (৪০), সহকারী রেজিস্ট্রার। আমির হোসেন (৩৮), কর্মচারী। মনিরুজ্জামান (৪০), সেকশন অফিসার। তৌহিদুল ইসলাম জনি (৪৫), উপ-রেজিস্ট্রার। রাফিউল হাসান রাসেল (৪৮), সহকারী রেজিস্ট্রার। নুর নবী (৪২), মাস্টার রোল কর্মচারী। মো. নুর আলম (৪০), নিরাপত্তা শাখার কর্মচারী। মোকতারুল ইসলাম (৪০), সহকারী রেজিস্ট্রার। আশিকুন্নাহার টুকটুকি (৩৫)। মোছা. মাহবুবা আক্তার (৩৮), উপ-রেজিস্ট্রার, সমাজবিজ্ঞান।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
মাহবুবার রহমান বাবু, কর্মচারী। মো. আপেল (৩৫), প্রক্টর অফিসের কর্মচারী। আবুল কালাম আজাদ (৪২), সাবেক ভিসির পিএ ও নিরাপত্তা দপ্তরের কর্মকর্তা। জিকরুল মাহবুব শোভন (৪০), যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, তাজহাট থানা আওয়ামী লীগ। শামিম হাসান হিটন (৪০), যুবলীগ কর্মী। শাহারিয়ার নয়ন (৩৫), মহানগর যুবলীগ কর্মী। ইশাক রিজন, ছাত্রলীগ কর্মী। আহসান হাবিব লালন (৩২), যুবলীগ কর্মী। আল আমিন (৪০), যুবলীগ কর্মী। সায়ির বিন আশরাফ আনন্দ (২২), ছাত্রলীগ কর্মী। আতিকুল বারী জামিন (৪২), সহ-সভাপতি, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, তাজহাট থানা। জাকির মুসা (৪০), স্বেচ্ছাসেবক লীগ কর্মী। মেহেদী হাসান সিদ্দিক রনি (৩২), সাধারণ সম্পাদক, যুবলীগ, রংপুর জেলা। মো. নয়ন (৪০), আওয়ামী লীগ কর্মী, চকবাজার। শিপন (৫০), যুবলীগ সেক্রেটারি, তাজহাট থানা। মো. আল ইমরান হোসেন (৪০), সহকারী পুলিশ কমিশনার, রংপুর। আরিফুজ্জামান (৪৫), সহকারী পুলিশ কমিশনার, রংপুর। রবিউল ইসলাম, অফিসার ইনচার্জ (ওসি), তাজহাট থানা। বিভূতি ভূষণ রায়, ফাঁড়ি ইনচার্জ। সুজন চন্দ্র রায়, কনস্টেবল। আমির আলী, কনস্টেবল। মো. আবু মারুফ হোসেন, উপ-পুলিশ কমিশনার। মো. শাহানুর আলম পাটোয়ারী, অতিরিক্ত পুলিশ উপ-পুলিশ কমিশনার, রংপুর।
মামলার সাক্ষী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. খোকন ইসলাম বলেন, দিনের আলোর মতো পরিস্কার হামলার মামলা হওয়ার ব্যাপারে কালক্ষেপণ আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। জুলাইয়ে যারা ছাত্রজনতার বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন তাদের সম্মিলিত সন্ত্রাসী হামলার ফলাফল ১৪০০ শহীদ ও ৫০ হাজার আহত। তাদের ব্যাপারে নমনীয়তাই জুলাই পরবর্তী আট মাসে তাদের চোরাগোপ্তা হামলা ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েমর দুঃসাহস তৈরী করে।
তিনি আরো বলেন, জুলাই পরবর্তী সময়ে সবথেকে বড় সংস্কার বলতে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারকেই বুঝি। বেরোবি প্রশাসন যে মামলা দায়ের করেছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, তবে মামলা যেন এখন নয়া রাজনীতির অংক হিসেব মেলানোর নয়া ফাঁদ হয়ে না দাঁড়ায়।
খোকন বলেন, যারা সরাসরি হামলায় জড়িত তা ভিডিও ফুটেজে স্পষ্ট হলেও কার হুকুমে এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে তাদের নামও তদন্ত সাপেক্ষে বের হয়ে আসবে এবং সকলের স্বাক্ষ্য প্রমাণ সাপেক্ষে যথাযথ বিচার কার্যকর হবে এটাই সবার আকাঙ্খা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. মো. হারুন অর রশীদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা বোর্ডের সিদ্ধান্ত এবং উপাচার্যের অনুমতিক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেছি। ঘটনার সময় আরো অনেকেই জড়িত ছিলেন। তাই মামলায় অজ্ঞাতনামা হিসেবে আরো ৮০ থেকে ১০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে তদন্তের মাধ্যমে তাদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
এদিকে, মামলার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেসপাস শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার মোকতারুল ইসলামকে (৪০) আটক করেছে পুলিশ। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মোসাদ্দেক।
তাজহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ আলম সরদার বলেন, আসামির তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, পুলিশ সদস্য, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আছেন। এ ছাড়াও অজ্ঞাতনামা ৮০ থেকে ১০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
মামলার ৪৬ নম্বর আসামি সহকারী রেজিস্ট্রার (ডেসপাস শাখা) মোকতারুল ইসলামকে আজকে সন্ধ্যার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুলিশ ফাঁড়ির সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।