ভোটারদের বয়স ১৬, এমপি প্রার্থীর ২৩ করার প্রস্তাব দিয়েছে এনসিপি
ভোটার হতে ন্যুনতম বয়স ১৬ আর জাতীয় সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচনে প্রার্থী হতে ন্যুনতম বয়স ২৩ করার প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। আজ মঙ্গলবার জাতীয় সংসদের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে এ প্রস্তাব দেয় দলটি।
বৈঠক শেষে করা ব্রিফিংয়ে এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম বলেন, ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন করার প্রস্তাব দিয়েছে এনসিপি। আমরা বিগত সময়গুলোতে দেখে এসেছি নির্বাহী বিভাগ তার জায়গায় একচ্ছত্র পুরো রাষ্ট্র পরিচালনায় আধিপত্য ছিল এবং অন্যান্য বিভাগগুলোতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতো। সেই জায়গায় জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল নির্বাহী বিভাগকে জবাবদিহিতায় রাখার একটা কাজ করবে। সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগদানের কাজ করবে।’
তিনি বলেন, ‘সংসদ সদস্যরা সংসদে তারা তাদের স্বাধীন মত প্রকাশ করতে পারবে, সরকারের স্থিতিশীলতা যাতে রক্ষা হয় সেখানে সাংবিধানিক একটা ব্যবস্থা থাকবে। ভোটারদের বয়স যাতে ১৬ এবং নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীর বয়স যেন ২৩ হয়। তথ্য প্রাপ্তির যে অধিকার এটাকে যেন মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রধান করা হয়। ক্ষমতায়ন এবং প্রতিনিধি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আমরা সরাসরি ১০০ আসনে নারী সংসদ সদস্যের কথা বলেছি।’
এনসিপির এ নেতা বলেন, ‘মৌলিক অধিকার বিরোধী দমনমূলক আইন ও সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৩(৩) এর সংস্কার। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল এবং সংবিধানের ৩৩(৩) প্রতিরোধমূলক আটকের যে ধারা এই ধারাটি সংস্কারের কথা আমরা বলেছি। আমরা বছরের পর বছর দেখেছি নির্বাচনের জন্য থ্রেট তাকে তুলে এনেছে, কোনো কারণে কেউ জানে না। এই আটকের কারণটা জানাতে হবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে তাকে হাজির করতে হবে।’
সারজিস আলম বলেন, ‘নির্বাহী ক্ষমতার ভারসাম্যের বিষয়ে আমরা বলেছি, প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে থাকতে পারবে, দলনেতা প্রধনমন্ত্রী এবং সংসদ সদস্য একই ব্যক্তি হতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট দেওয়া যাবে এটাও আমরা তুলে ধরেছি।’
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
তিনি বলেন, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেটা এতদিনে আমাদের প্রত্যাশার ধারে কাছেও দেখতে পাইনি। সেখানে বিচার বিভাগের নিজস্ব প্রশাসনিক সচিবালয় গঠন, জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন। প্রধান বিচারপতি জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নিয়োগ। বিচারপতি নিয়োগে জুডিশিয়াল নিয়োগ ও মেধাভিত্তিক পরীক্ষা। আপিল বিভাগে বিচারপতি নিয়োগে নিরপেক্ষ নিয়োগ পদ্ধতি এবং বিভাগীয় শহরগুলোতে হাইকোর্টের স্থায়ী আসন স্থাপন করার বিষয় তুলে ধরেছি।’
এনসিপির এ নেতা বলেন, ‘দুদককে রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠান বানানো হয়েছে। ক্ষমতায় যাওয়ার হাতিয়ার বানিয়েছে, দুদককে যেন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সরকারি ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা যারা ছিল, তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা দায়েরের স্বাধীনতা দুদকের ছিল না। দুদকের আইনের ৩২(ক) ধারায় বলা ছিল, যে সরকারি কর্মকর্তা বা বিচার বিভাগীয় যে কর্মকর্তা তাদের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করতে চাইলে, সরকারে পূর্বানুমতি নিতে হবে। এই ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি, এই প্রক্রিয়াটি দুর্নীতি রোধে একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এটাকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করা যায়, তাই আমাদের পার্টির পক্ষ থেকে এই দুদকে ৩২(ক) ধারাটি বাতিল করতে হবে।’
দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচনের প্রক্রিয়া বাতিল করার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে জানিয়ে সারজিস আলম বলেন, ‘এই প্রসেসের মধ্য দিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা সম্পন্ন মানুষ দলীয় ট্যাগ লাগাতে হবে বলে রাজনীতি থেকে সরে গিয়েছে। জনপ্রতিনিধি হওয়া থেকে বিমুখ হয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘জনপ্রশাসনের ক্ষেত্রে আমরা আলাদা সংস্কারের প্রস্তাব করেছি। নাগরিক সেবা নিশ্চিতকরণ আইন প্রণয়নের কথা বলেছি। নাগরিক সেবা প্রধান অভিযোগ প্রতিকার নিশ্চিত করতে প্রশাসনিক ন্যায়পাল হিসেবে স্বাধীন সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান নাগরিক সেবা ও অভিযোগ প্রতিকার কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছি।’
সারজিস আলম বলেন, ‘মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে নতুন প্রশাসনিক উন্নয়ন এবং সংস্কার বিভাগ সৃজন করার প্রস্তাব দিয়েছি। এসব বিষয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে সামগ্রিক বিষয়গুলো দ্রুত রেসপন্স এবং দ্রুত সমন্বয় করার জন্য ওয়ানস্টপ সার্ভিসের কথা বলেছি। এই সেবার বিষয়গুলো কতটুকু সময়সীমার মধ্যে শেষ করতে হবে এবং না করলে তাকে কীভাবে জবাবদিহি করতে হবে এবং তার কী শাস্তি হবে এ সামগ্রিক বিষয়গুলোর একটি রূপ রেখা আমরা আমাদের জায়গা থেকে দিয়েছি ‘
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
ব্রিফিংয়ে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘বর্তমানে আমরা যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে নামেই দেওয়া হোক না কেন, তার পূর্বে যেন নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নাম দেওয়া হয়। যাতে করে সেই সরকার দীর্ঘ সময় থাকার যে মানসিকতা, সেটা কমে আসে এবং তাদের যেন শুধু নির্বাচনের ব্যাপারেই ফোকাসটা থাকে সেটা আমরা তুলে ধরেছি।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় ধরে পেশিশক্তি নির্ভর রাজনীতি চলছে, সেই পেশিশক্তি নির্ভর রাজনীতি থেকে বের হয়ে পলিসি নির্ভর রাজনীতি যাতে প্রতিষ্ঠিত হয় সেজন্য আমরা ছায়ামন্ত্রী সভার কথা বলেছি। সংসদীয় যে যে স্থায়ী কমিটিগুলো আছে, সেগুলো সুনির্দিষ্ট ছায়া মন্ত্রীসভার কার্যক্রম কী হতে পারে সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। সংসদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটি যেমন পাবলিক একাউন্স কমিটি, পরিকল্পনা, জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির প্রধান বিরোধীদল থেকে হতে হবে। অন্যান্য জায়গায়ও যেন এই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এই ক্ষমতার ভারসাম্যটা আমাদের দেশ সুষ্ঠুভাবে চলার জন্য খুব প্রয়োজন।’
আগে বলেছিলেন সংবিধান পুনর্লিখন এখন বলছেন সংবিধান সংস্কারের কথা, আর সেটা কবে চান? নির্বাচনের আগে না পরে? এমন প্রশ্নের জবাবে আখতার হোসেন বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির দুই দফা বৈঠকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের যে প্রক্রিয়া সেটা কি রকম হতে পারে সেটা আমরা উত্থাপন করব। এই সংস্কার কার্যক্রম কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায় সেটা নিয়ে এখনও ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামোতে ভরপুর। এর বাইরে এসে নতুন একটি সংবিধানের কথা বলে এসেছি। সেই সংবিধানকে বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই গণপরিষদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে, একটি গণপরিষদ গঠন করে তাদের ওপরে অর্পিত দায়িত্ব যা থাকবে তার মধ্য দিয়ে নতুন করে সংবিধান লেখা প্রয়োজন। নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা প্রয়োজন। সে জন্য অবশ্যই রাজনৈতিক ঐকমত্যের দরকার রয়েছে, সেই বিষয়গুলো আমরা ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আমরা আলোচনা করব।’
এনসিপি সদস্যসচিব বলেন, ‘এনসিপি মনে করে সরকারে পক্ষ থেকে বিচার এবং সংস্কার কাজের দৃশ্যমানতা যদি আন্তরিকতা থাকে এবং অপরাপর রাজনৈতিক দলে সহযোগিতা থাকে তালে প্রধান উপদেষ্টা যে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছেন, সেই সময়ের মধ্যেই সেটাকে সামনে নিয়ে আসা সম্ভব এবং নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের ব্যাপারে এনসিপি মনে করে, নির্বাচন যেকোনো সময় হতে পারে, তবে আগে মৌলিক সংস্কারের যে রূপ রেখা সেটা বাস্তবায়ন করতে হবে। মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা বাস্তবায়ন এবং গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের বিচারকে দৃশ্যমান পর্যায়ে নিয়ে আসার দিন থেকে অল্প দিনের মধ্যেই এনসিপি নির্বাচনের আয়োজনের জোর আরোপ করেছে।’
আখতার হোসেন আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে সব থেকে বড় সমস্যা শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের সমস্যা এবং বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি দলীয় সরকারের অধীনে যে নির্বাচন হয়েছে সেটা মোটা দাগে অগ্রহণযোগ্য এবং সেই নির্বাচনগুলো একপেশে নির্বাচন হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থাহীনতার একটা জায়গা রয়েছে। সেই ক্ষেত্রে কীভাবে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে যেতে পারি। আমরা এগুলো নিয়ে সুস্পষ্ট রূপ রেখা হাজির করব।’