ব্যাংক খাতে মূলধন ঘাটতির অবনতি
ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হওয়ার পর মূলধন ঘাটতি পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। সর্বশেষ গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে ২০টি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বেড়ে হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৭২ হাজার কোটি টাকা। এ সময়ে সর্বোচ্চ মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। এর বাইরে এস আলমের রাহুমুক্ত ব্যাংকগুলোও বড় ধরনের মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানা অনিয়ম ও লুটপাটের মাধ্যমে যেসব ঋণ বের করে নেওয়া হয়েছিল, পটপরিবর্তনের পর তা খেলাপি হিসেবে প্রদর্শন করা শুরু করেছে ব্যাংকগুলো। এতে গত বছর রেকর্ড পরিমাণ খেলাপি ঋণ বেড়েছে। আর খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। ফলে এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোর মূলধন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। কিন্তু নিয়ম মেনে অনেক ব্যাংকই তা সংরক্ষণ করতে পারছে না। সংশ্লিষ্টরা জানান, যেসব ব্যাংকের মূলধনে ঘাটতি থাকে, সেগুলো শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ প্রদান করতে পারে না। আবার অন্য দেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে সেগুলোকে অসুবিধার মুখে পড়তে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, তফসিলি ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম চালানোর জন্য ন্যূনতম রক্ষিতব্য মূলধন (এমসিআর) ও ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফার (সিসিবি) থাকতে হবে, সেগুলোর মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ ও আড়াই শতাংশ হারে। সেই সঙ্গে মূলধন ও দায়ের মধ্যে যথাযথ ভারসাম্য রক্ষায় ব্যাসেল-৩ কাঠামোর আলোকে ঝুঁকিভিত্তিক মূলধন পর্যাপ্ততার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে ২০১৫ সাল থেকে ন্যূনতম ৩ শতাংশ লিভারেজ অনুপাত (এলআর) সংরক্ষণ করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়, যা ২০২৩ সাল থেকে বার্ষিক দশমিক ২৫ শতাংশ হারে ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে ২০২৬ সালে ৪ শতাংশে উন্নীত করার নির্দেশনা রয়েছে। সে অনুযায়ী ২০২৪ সালের জন্য তফসিলি ব্যাংকগুলোকে লিভারেজ অনুপাত ন্যূনতম সাড়ে ৩ শতাংশ হারে সংরক্ষণ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। তবে এসব নিয়ম মেনে গত বছরের ডিসেম্বর ত্রৈমাসিকে অন্তত ২০টি ব্যাংক মূলধন সংরক্ষণ করতে পারেনি। এ তালিকায় আছে রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি, বিশেষায়িত দুটি, বেসরকারি ১৩টি ও বিদেশি একটি ব্যাংক।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে- ২০২৪ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিকে এই ২০টি ব্যাংক সম্মিলিতভাবে ১ লাখ ৭১ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে, যা এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। অথচ এক বছর আগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০টি ব্যাংক ৩৯ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতির সামনে পড়েছিল। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ সময়ে সবচেয়ে বেশি মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক, যার ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫২ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ১৮ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংক ১৫ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ১৩ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ১২ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ১১ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা, আইএফআইসি ব্যাংক ৯ হাজার কোটি টাকা ও ন্যাশনাল ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া রূপালী ব্যাংক ৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংক ৪ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংক ৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, পদ্মা ব্যাংক ৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, এবি ব্যাংক ৫০০ কোটি টাকা, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ২৫০ কোটি টাকা এবং বিদেশি হাবিব ব্যাংকের ১২ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, গত বছর শেষে সার্বিক ব্যাংক খাতে মূলধন ভিত্তিরও অবনতি হয়েছে। এ সময়ে মূলধন পর্যাপ্ততা অনুপাত (সিএআর) নেমে এসেছে ৩ দশমিক ০৮ শতাংশে, যা গত সেপ্টেম্বরে ছিল ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের মোট ঋণের ৯ শতাংশ। সেই হিসাবে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ১৩১ কোটি টাকা।