জুলাইয়ের শহীদ-আহতদের জন্য বরাদ্দ ৫৯৩ কোটি টাকা
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের গল্পগাথা থাকবে। গত জুলাই ও আগস্ট মাসে বাংলাদেশে সংঘটিত হয় এক গণ-আন্দোলন। জুলাই অভ্যুত্থান নামে পরিচিতি পাওয়া এ গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। রক্তক্ষয়ী এ অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয় টানা দেড় দশক ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা সরকার। এ সময় দেশের অর্থনীতির নীতি প্রণয়নে অংশীজনদের মতামত গ্রহণের বিষয়টি ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। আয়ের উৎস না বাড়িয়ে ক্রমাগত টেনে লম্বা করা হয়েছে বাজেটের আকার। অনিয়ম-দুর্নীতি আর অপব্যয়ের চাপে বড় হয়েছে বাজেট ঘাটতি। ঋণনির্ভরতার কারণে সরকারের ঘাড়ে চেপেছে প্রায় ২০ লাখ কোটি টাকার দেশি-বিদেশি ঋণের বোঝা। সেখান থেকে বের হয়ে একটি বৈষম্য নিয়ন্ত্রণের বাজেট দিতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। আগামী অর্থবছরের বাজেটে গণ-অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন থাকবে। জুলাই-আগস্ট বিদ্রোহের সময় শহীদদের পরিবার এবং আহতদের মাসিক ভাতা এবং এককালীন আর্থিক অনুদান দেওয়ার জন্য সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় ৫৯৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে যাচ্ছে। এর মধ্যে ২০৬ কোটি টাকা মাসিক ভাতা বাবদ এবং বাকি টাকা এককালীন অনুদান হিসেবে দেওয়া হবে। খবর অর্থ বিভাগ সূত্রের।
ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘জুলাই বিপ্লব বাংলাদেশের অস্তিত্ব। এ জন্য বাজেট বক্তৃতায় অবশ্যই তা তুলে ধরতে হবে।’
জানা গেছে, রেকর্ড রাজস্ব ঘাটতি, ঋণ পরিশোধের চাপ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের বেড়াজালসহ নানা চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন এ সরকারের প্রথম বাজেটে জনগণের প্রত্যাশাও বিপুল। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, আগামী অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রণয়নের প্রস্তুতি নিচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়, চলতি অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটের তুলনায় যা ৭ হাজার কোটি টাকা কম। বাজেটের আকার কমিয়ে আনার প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে আইএমএফ। আর নতুন বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রধান লক্ষ্য ধরা হয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
জানা গেছে, আগামী ২ জুন, সোমবার বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। আগামী অর্থবছরের বাজেটে রাখা হচ্ছে না বড় কোনো উন্নয়ন প্রকল্প। এ ক্ষেত্রে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হতে পারে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এডিপির আকার ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছিল। যদিও অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই এ আকার বড় কাটছাঁট করার প্রস্তুতি চলছে। আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নে গ্রামীণ পর্যায়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে জোর দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য বাড়তি নজর দেওয়া হচ্ছে রাস্তাঘাট নির্মাণ, সংস্কারসহ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে। বাড়ানো হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতা। সীমিত সাধ্যের মধ্যে বাড়ানো হবে ভাতাভোগীর সংখ্যাও। প্রায় তিন বছর ধরে দেশে মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে ৯-১১ শতাংশের ঘরে। জনগণকে স্বস্তি দিতে আগামী অর্থবছরের বাজেটে এ হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা থাকতে পারে। আর উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য থেকে সরে এসে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণ করা হতে পারে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
এদিকে অব্যাহত মূল্যস্ফীতির চাপের কারণে গত দুই বছরে মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) গবেষণা তথ্য অনুযায়ী অন্তত ৭৮ লাখ মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ৩৮ লাখ লোক অতি দরিদ্র হয়ে পড়েছে। আর ৯৮ লাখ ৩০ হাজার মানুষ অতিমাত্রায় দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা এবং ভাতার অঙ্ক বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিদিরা। সংশ্লিষ্টদের মতে, অর্থ সংকটের কারণে বড় ধরনের উদ্যোগ থাকছে না সরকারের পক্ষ থেকে।
এদিকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ঘিরে দুর্নীতি, অপচয় প্রতিরোধ ও প্রকৃত সুবিধাভোগী শনাক্ত করার মতো চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্তর্বর্তী সরকারের বলয় বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও এ খাত ঘিরে দুর্নীতির বিষয়টি প্রথমে আলোচনায় নিয়ে আসেন সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ নিজেই। সম্প্রতি তিনি বলেন, ‘শুধু অর্থ বরাদ্দ দিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সফল হবে না। সামাজিক সুরক্ষা খাতে দুর্নীতি বড় বাধা, ফলে শক্তিশালী তদারকি প্রয়োজন। এ খাতে উপকারভোগীদের তালিকায় দুর্নীতি আছে। ড্যাশবোর্ড তৈরি হলে সামাজিক সুরক্ষার কর্মসূচিগুলোর কার্যক্রম জোরালো নজরদারির মধ্যে রাখা সম্ভব হবে।’
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের ৮ মাসে বাজেটের অর্ধেকও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। মূল বাজেট তো দূরের কথা, সংশোধিত বাজেটও অর্ধেক বাস্তবায়ন করা যায়নি বলে অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
অর্থ বিভাগের পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই ‘২৪-ফেব্রুয়ারি ‘২৫) বাজেট বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে অর্ধেকের চেয়ে কম। আলোচ্য সময়ে মূল বাজেটের প্রায় ৪০ শতাংশ এবং সংশোধিত বাজেটের প্রায় ৪৩ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। এর আগের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে বাজেট বাস্তবায়ন হার ছিল মূল বাজেটের প্রায় ৩৭ শতাংশ এবং সংশোধিত বাজেটের প্রায় ৪০ শতাংশ। সে হিসেবে উভয় ক্ষেত্রেই চলতি অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে বাজেট বাস্তবায়ন হার প্রায় ৩ শতাংশ বেড়েছে।
অর্থ বিভাগের পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে, চলতি অর্থবছরের ৮ মাসে মোট পরিচালন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৮ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। এটি সংশোধিত পরিচালন ব্যয়ের ৫১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে সংশোধিত পরিচালন ব্যয়ের আকার হচ্ছে ৫ লাখ ৬ হাজার ২ কোটি টাকা। মূল বাজেটে এর আকার ছিল ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা।
এদিকে, আলোচ্য সময়ে এডিপি বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে সংশোধিত বাজেটের ২৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ। চলতি অর্থছরের মূল বাজেটে এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে কাটছাঁট করে এর আকার ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর বিপরীতে আট মাসে মোট ব্যয় হয়েছে ৫৭ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে এডিপি-তে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৬২ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগের হিসাব মতে, চলতি অর্থবছরের আট মাসে এনবিআরের আওতাধীন মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে ২ লাখ ৬৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৫৩ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫১ হাজার ২০২ কোটি টাকা।