চলে গেলেন শহীদকন্যা রেখে গেলেন প্রশ্ন

নিজস্ব প্রতিবেদক, পটুয়াখালী ও দুমকি প্রতিনিধি
২৮ এপ্রিল ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
চলে গেলেন শহীদকন্যা রেখে গেলেন প্রশ্ন

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার গাড়িচালক জসিম উদ্দীন হাওলাদার। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে শহীদ পরিবারটি। বাবা হারানোর সেই শোক কাটিয়ে না উঠতেই অতর্কিত এক ঝড় এসে ল-ভ- করে দিয়েছে শহীদ জসিম উদ্দীনের কলেজপড়–য়া কন্যা লামিয়ার (১৭) জীবন। বাবার কবর জিয়ারত শেষে ফেরার পথে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন তিনি। নরপশুদের এ হিংস্রতা মেনে নিতে পারেননি লামিয়া। তাই বেছে নেন আত্মহননের পথ। ভীষণ অভিমান নিয়ে শহীদ বাবার মতো তিনিও চলে গেছেন না ফেরার দেশে; পার্থিব সব হিসাব-নিকাশের ঊর্ধ্বে। রেখে যান মানবতার ধ্বজাধারীদের জন্য এক আকাশ লজ্জা আর অসংখ্য প্রশ্ন।

লামিয়াকে ধর্ষণ এবং তার আত্মহত্যার ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড় চলছে। ধর্ষণকা-ে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন সবাই।

গত ১৮ মার্চ সন্ধ্যায় শহীদ জসিম উদ্দীনের কবর জিয়ারত করে নানাবাড়িতে ফেরার সময় রাস্তা থেকে লামিয়াকে তুলে নিয়ে যায় নরপশুরা। তারা দুমকি উপজেলার পাংগাশিয়া ইউনিয়নে সংঘবদ্ধভাবে পাশবিক নির্যাতন চালায় কলেজছাত্রী লামিয়ার ওপর। এমনকি ধর্ষণের সময় পাষ-রা তার নগ্ন ভিডিও ধারণ করে সামাজিক মাধ্যমে

ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ রাখতে বলে। ঘটনার দুদিন পর থানায় গিয়ে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে নিজেই মামলা দায়ের করেন লামিয়া। এরপর আদালত আসামিদের কারাগারে পাঠান। কিন্তু বেশিদিন নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি এ তরুণী। ঘটনার পর থেকেই মারাত্মক মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিলেন। সামাজিক লোকলজ্জার ভয়, অবহেলা, মামলা তোলার চাপ ও বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতায় হতাশগ্রস্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি বেছে নেন আত্মহননের পথ। গত শনিবার রাতে রাজধানীর শেখেরটেক এলাকায় নিজ কক্ষ থেকে গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় পুলিশ উদ্ধার করে তার নিথর দেহ।

গতকাল রবিবার দুপুরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে লামিয়ার মরদেহ পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার পাংগাসিয়া ইউনিয়নের ধোপার হাট গ্রামে তার দাদার বাড়িতে নেওয়া হয়। এ সময় স্বজনদের আহাজারিতে সেখানে এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তার মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে এলাকাবাসী। গতকাল রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় পটুয়াখালীর পাংগাশিয়া ইউনিয়নের পাংগাশিয়া বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে দাদার বাড়িতে লামিয়াকে তার শহীদ বাবার পাশেই সমাহিত করা হয়।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফিন, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তর অঞ্চল) সারজিস আলম, গণঅধিকার পরিষদ উচ্চতর পরিষদ সদস্য কৃষিবিদ মো. শহিদুল ইসলাম ফাহিম, দুমকি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুজর মো. ইজাজুল হক, দুমকি থানার ওসি মো. জাকির হোসেন, পটুয়াখালী জেলা জামায়াতের আমির অ্যাডভোকেট নাজমুল আহসান, আমরা বিএনপি পরিবারের আহ্বায়ক আতিকুর রহমান রুমন, সদস্য সচিব কৃষিবিদ মোকছেদুল মোমিন মিথুন, জাতীয় প্রেসক্লাবের স্থায়ী সদস্য জাহিদুল ইসলাম রনি, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আমানউল্লাহ আমান, পটুয়াখালী ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ্ আল নাহিয়ান প্রমুখ। এ ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন জানাজায়। তারা সবাই শহীদকন্যার আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারী ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন।

এদিকে আলোচিত এই শহীদকন্যা ধর্ষণকা-ের পর সারাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। গত ২০ মার্চ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তাদের খোঁজখবর নেন। এ ছাড়া এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ পটুয়াখালীতে এসে ভুক্তভোগী পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস প্রদানের পাশাপাশি দোষীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে শাস্তির দাবি জানান।

নিহতের স্বজনরা জানান, গত ১৮ মার্চ পটুয়াখালীর পাংগাশিয়া ইউনিয়নে নিজ বাড়ি থেকে নানাবাড়ি যাওয়ার পথে লামিয়া সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। সাহসিকতার সঙ্গে তিনি নিজে থানায় গিয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলাটি বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে। ইতোমধ্যে দুমকি থানা পুলিশ অভিযুক্ত সাকিব মুন্সী ও সিফাত মুন্সীকে গ্রেপ্তার করেছে। ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর থেকেই লামিয়া গভীর মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিলেন। সামাজিক লোকলজ্জা, অবহেলা এবং ন্যায়বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা তার মধ্যে চরম হতাশা তৈরি করে। সেই হতাশা থেকেই তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হন, বলেছেন স্বজনরা।

লামিয়ার দাদি রাবেয়া বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, দেশের জন্য তার ছেলে জুলাই আন্দোলনে জীবন দিয়েছে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ ছিল তার ছেলে জসিম। তাকে হারিয়ে তারা চরম অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। এরই মাঝে তার নাতনি লামিয়াকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। নাতনি লোকলজ্জার ভয়ে বাধ্য হয়ে গলায় দড়ি দিয়েছে। যাদের কারণে সে মরল সরকারের কাছে তাদের কঠিন বিচার দাবি করেন শহীদ জসিম উদ্দিনের মা-বাবা।

সরেজমিন গতকাল দুপুরে দেখা গেছে, দুমকির ধোপারহাট গ্রামে নিজ বাড়িসংলগ্ন আঙিনায় শহীদ জসিম উদ্দীন হাওলাদারের কবরের পাশে তার বৃদ্ধ বাবা সোবহান হাওলাদার নাতনি লামিয়ার জন্য একাই কবর খুঁড়ছেন। এর আগে ছেলের মরদেহ দাফনের জন্যও কবর খুঁড়েছিলেন এই বৃদ্ধ। তিনি বলেন, শনিবার সকালেও নাতনির সঙ্গে কথা হইছিল। আমার নাতনিটা আজ বাড়ি আসবে বলছিল। কিন্তু সে যে লাশ হয়ে আসবে, তা বুঝি নাই। জেলা প্রশাসক সহায়তার দুই লাখ টাকা আনতে তাকে ফোন করেছেন বলে নাতনিকে জানিয়েছিলাম। নাতনি জানায়, জেলা প্রশাসক তাকে সোমবার যেতে বলেছেন। কিন্তু রাত ১০টার দিকে ওর আত্মহত্যার কথা জানতে পারি। জুলাই আন্দোলনে ছেলেকে হারালাম। ১৮ মার্চ নাতনি ধর্ষণের শিকার হয়। আসামিরাও ধরা পড়ে জেলহাজতে আছে। ভাবছিলাম, ছেলে গেছে নাতনি তো বেঁচে থাকবে। কিন্তু সেও আমাদের ছাইড়া চইল্লা গেল। কান্নায় ভেঙে পড়েন পুত্র-নাতনিহারা বৃদ্ধ।

রাজধানীর আদাবর থানার এসআই কমল চন্দ্র ধর বলেন, শেখেরটেকের একটি বাসা থেকে লামিয়ার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, তার মৃত্যুর ঘটনাটি আত্মহত্যাজনিত। পুরো ঘটনাটি নিবিড়ভাবে তদন্ত চলছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর তার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।

দুমকি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন জানান, লামিয়া ধর্ষণের ঘটনায় প্রধান আসামিসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। বর্তমানে তারা জেলহাজতে রয়েছে।

লামিয়ার শোকাহত পরিবারের পাশে তারেক রহমান

চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে শহীদ জসিম উদ্দিনের কন্যা লামিয়া আক্তারের শোকাহত পরিবারের পাশে দাঁড়াতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও ‘আমরা বিএনপি পরিবার’-এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক তারেক রহমান পটুয়াখালীর দুমকিতে একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছেন।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও ‘আমরা বিএনপি পরিবার’-এর প্রধান উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীর নেতৃত্বে গতকাল রবিবার বিকালে প্রতিনিধি দলটি পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার দক্ষিণ পাংগাসিয়া ইউনিয়নের নলদোয়ানী গ্রামে যায়। এ সময় লামিয়া আক্তারের পরিবারের প্রতি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সহমর্মিতার বার্তা পৌঁছে দেন রুহুল কবির রিজভী। পাশাপাশি শহীদ জসিম উদ্দিনের বৃদ্ধ পিতা সোবহান হাওলাদারের হাতে আর্থিক সহায়তা তুলে দেন তিনি।

লামিয়া আক্তারের জানাজা শেষে চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে শহীদ তার পিতা জসিম উদ্দিনের কবর জিয়ারত করে বিএনপির প্রতিনিধি দলটি।

মহিলা পরিষদের উদ্বেগ

এদিকে শহীদকন্যা লামিয়াকে দলবদ্ধ ধর্ষণের পর আত্মহত্যার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। গতকাল এক বিবৃতিতে সংগঠনটি দ্রুত অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে। একই সঙ্গে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। বিবৃতিতে নারীর প্রতি সহিংসতার ক্রমবর্ধমান প্রবণতায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’ নীতির ভিত্তিতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানানো হয়েছে। পাশাপাশাশি সহিংসতা প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বানও জানানো হয়।