‘টাকা না দেওয়া পর্যন্ত লাঠি চলবে’

মাদারীপুর প্রতিনিধি
২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১৯:৫৯
শেয়ার :
‘টাকা না দেওয়া পর্যন্ত লাঠি চলবে’

উন্নত জীবন গড়ার প্রত্যাশায় ইতালি যাওয়ার পথে লিবিয়ার বন্দী শালায় আটকে রেখে মাদারীপুরের তিন যুবককে ভয়াবহ নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করেও তাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় আদালতে মামলা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে দালাল চক্র। উল্টো ভুক্তভোগী পরিবারে মিথ্যা মামলার হুমকি দিয়ে নানাভাবে করা হচ্ছে হয়রানি। তবে পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছে।

লিবিয়ায় মাফিয়াদের হাতে বন্দীরা হলেন মারুফ হোসেন, মহিউদ্দিন মোড়ল ও সোলায়মান আকন।

মাদারীপুর সদর উপজেলার মধ্য হাউসদী এলাকার বাবুল ফকিরের ছেলে মারুফ হোসেন এবং তার ভাগ্নে মহিউদ্দিন মোড়ল লিবিয়ায় অবস্থানরত এক দালালের কাছে বন্দী রয়েছে। ওই দালাল বাবুল ফকিরকে মোবাইলে হুমকি দিয়ে চাওয়া হচ্ছে মোট অঙ্কের টাকা। হুমকির অডিও রেকর্ড হুবহু তুলে ধরা হলো-

বাবুল ফকির বলেন, ‘ভাই আমি গরীব মানুষ। টাকা জোগাড় করার সময় দেন।’ অপর প্রান্ত থেকে গালাগালি করে দালালের হুমকি, ‘তোরে তো এক ঘণ্টা সময় দিয়েছি।’ ভুক্তভোগীর বাবা বলেন, ‘একটু দয়া করেন ভাই, একটু দয়া করেন। মোটরসাইকেল বেইচ্যা আপনারে এক লাখ টাকা দিতেছি। সময় না দিলে এতোগুলো টাকা কোথা থেকে দিমু?’

দালাল বলেন, ‘এর আগেও তিনদিন দিছি সময়। ওগোরে যে ছাড়াই আনছি ওগো তো কম টাকা লাগতেছে। তোরা কি এহন জানোস বর্তমানে মাফিয়াগো হাতে গেলে কত টাকা লাগে? ওগো তো কম টাকা লাগতেছে। এক এক জনের বিশ লাখ টাকা লাগে।’

মারুফের বাবা বলেন, ‘দিমু তো। আপনারা আনছেন পাড়াই দিমু আপনাগো টাকা।’ জবাবে কর্কশ কণ্ঠে দালাল বলেন, ‘তোগো একটা সুযোগ দিছি। আজকে এক লাখ দিবি, পরশু ৫ লাখ করে দুই জনে ১০ লাখ দিবি। পরের দিন ক্লিয়ার করে দিবি।’

ভুক্তভোগীর বাবা বলেন, ‘ঠিক আছে ভাই একটু আমারে সময় দেন।’ এরপর দালালের হুংকার, ‘টাকা দিতে যতক্ষণ লেট হইবে ততক্ষণ ওদের উপর লাঠি চলবে। পরে ভিডিও কইর‌্যা পাঠাই দেবোনে।’

মারুফের বাবা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘ভাই এমন কইরেন না, ভাই দয়া করেন।’ সবশেষ দালাল বলে, ‘টাকা দিয়া ফোন দিবি, একেবারে সন্ধ্যার আজানের পর।’

এভাবেই লিবিয়ায় বন্দীদের আটকে রেখে স্বজনদের থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করে দালাল চক্র।

সরেজমিনে জানা গেছে, মাদারীপুর সদর উপজেলার মধ্য হাউসদী গ্রামের মারুফ হোসেন, মহিউদ্দিন মোড়ল, সোলায়মান আকন। বাড়িতে থাকতে ওদেরকে ইতালিতে মোটা বেতনের প্রলোভন দেখায় দালাল চক্র। এরপর লিবিয়া নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন চালায়। নির্যাতনের সময় স্বজনদের মোবাইলে শোনানো হয় নির্যাতনের বর্ণনা। এরপর আদায় করা হয় টাকা।

এ ঘটনায় জড়িত দালালদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন স্বজন ও এলাকাবাসী। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দালালরা কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে মানবপাচার করে থাকেন। প্রথম ধাপের দালালরা গ্রামাঞ্চলের সহজ সরল মানুষদের অল্প টাকায় ইতালি নেওয়ার প্রলোভন দেখায়। এই ফাঁদের পা দিলেই তারা ভুক্তভোগীদের লিবিয়াতে অবস্থানরত মাফিয়াদের হাতে তুলে দেয়। এরপর থেকে বন্দিশিবিরে আটকে রেখে নির্যাতন করে আদায় করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা। নির্যাতনে অনেকেই প্রাণ হারায়। চক্রের সাথে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য (মেম্বার, চেয়ারম্যান), পুলিশ প্রশাসন, ব্যাংক কর্মকর্তারাও জড়িত।

ভুক্তভোগীর স্বজনরা জানান, দালালের প্রলোভনে ৬ মাস আগে ইতালির উদ্দেশে বাড়ি ছাড়ে মাদারীপুর সদর উপজেলার মধ্য হাউসদী গ্রামের মারুফ হোসেন, মহিউদ্দিন মোড়ল ও সোলায়মান আকন। প্রথম কিছু দিন তাদের সাথে স্বজনদের যোগাযোগ থাকলেও এখন তাদের সাথে যোগাযোগ নেই। লিবিয়ায় নেয়ার পরে তাদের অমানসিক নির্যাতন করে। ভিটামাটি বিক্রি করার পাশাপাশি চড়াসুদে টাকা এনে দালালদের হাতে তুলে দেয় স্বজনরা। টাকা আদায়ের পর দীর্ঘদিন ধরে নেই যোগাযোগ। বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে তাও জানে না স্বজনরা।

এই ঘটনায় স্থানীয় দালাল হাওয়া বেগম ও বাবুল মাতুব্বরের নামে ভুক্তভোগী পরিবার একাধিক মামলা করেছে। এরপরও মিলেনি সন্ধান। গ্রেপ্তার হয়নি দালাল চক্র। উল্টো আরও দেওয়া হচ্ছে হুমকি।

নিখোঁজ সোলায়মান আকনের মা সালমা আক্তার বলেন, ‘আমার ছেলেকে লিবিয়ায় আটকে রেখে নির্যাতন করে দফায় দফায় মুক্তিপণ চেয়ে টাকা আদায় করে দালালরা। কয়েক দফায় বিভিন্ন ব্যাংক হিসেবে মোট ৩৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা দিয়েছি। এরপরও আমার ছেলের কোন সন্ধান পাইনি। উল্টো আমাদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করার হুমকি দিচ্ছে স্থানীয় দালাল হাওয়া বেগম এবং বাবুল মাতুব্বর।

নিখোঁজ মারুফ হোসেনের বাবা এবং মহিউদ্দিন মোড়লের মামা বাবুল ফকির বলেন, স্থানীয় দালাল হাওয়া বেগম এবং বাবুল মাতুব্বর আমাদের সহজে ইতালি নেওয়ার প্রলোভন দেখায়। এরপর লিবিয়াতে নিয়ে আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবী করে। আমাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬২ লাখ পঞ্চাশ হাজার নিয়েছে ওই দালাল চক্র। এরপরও সন্ধান পাইনি আমার ছেলে ও ভাগ্নের।

এ ঘটনায় অভিযুক্ত হাওয়া বেগম ও বাবুল মাতুব্বরের সাথে যোগাযোগ করতে তাদের বাড়িতে গেলে তাদের পাওয়া যায়নি। বাবুল মাদারীপুর শহরের চরমুগরিয়া বন্দর শাখা সোনালী ব্যাংকে কর্মরত। তবে মামলার পর থেকে ব্যাংকে তিনি অনুপস্থিত রয়েছেন।

মাদারীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আদিল হোসেন জানান, দালালদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। হুমকি দিয়ে থাকলেও সেটাও গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হবে।

মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাঈমুল হাছান বলেন, মানব পাচারের বিষয়ে তদন্তপূর্বক আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।