রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ /

বিচারকাজ গতিহারা

রহমান জাহিদ
২৪ এপ্রিল ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বিচারকাজ গতিহারা

আজ বৃহস্পতিবার রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে আটতলা রানা প্লাজা ভবন ভেঙে পড়ে ১১শর বেশি পোশাক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। যা শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্ব-ইতিহাসেরই অন্যতম ভয়াাবহ শিল্প-দুর্ঘটনা। তবে ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া হত্যাসহ তিন মামলায় বিচারকাজ একরকম গতিহারাই বলা যায়। কারণ তিন মামলায় অগ্রগতি সামান্যই; ৪২ আসামির মধ্যে ভবনটির মালিক সোহেল রানাই একমাত্র কারাগারে আছেন। অপর আসামিদের মধ্যে ৭ জন পলাতক, ৩২ জন জামিনে ও ২ জন মারা গেছেন।

মামলার নথি থেকে দেখা যায়, খুনের মামলার তদন্তে সময় লেগেছে দুই বছর। ছয় সরকারি কর্মকর্তাকে চার্জশিটভুক্ত আসামি করার ক্ষেত্রে অনুমতি না পাওয়ায় তদন্ত শেষ করতে বিলম্ব হয়। জনপ্রশাসন ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের যুক্তি ছিল, যারা বড় অপরাধ করেনি, তাদের চার্জশিটভুক্ত করার অনুমতি দেবে না তারা। তবে অনুমোদন না পেলেও তাদের আসামি করে চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি। এর পর মামলার বিচার শুরুর আদেশ হয় আরও এক বছর পর।

তবে বিচার শুরুর আদেশ চ্যালেঞ্জ করে মামলার সাত আসামি উচ্চ আদালতে গেলে তাদের পক্ষে বিচারকাজে স্থগিতাদেশ আসে। এ কারণে প্রায় পাঁচ বছর বন্ধ ছিল মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম। পরবর্তী সময়ে ছয়জনের পক্ষে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলে ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করেন ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালত। গত ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মামলার ৫৯৪ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ৯৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। সর্বশেষ গত ১৫ এপ্রিল সাক্ষ্যগ্রহণের ধার্য দিনে সাক্ষী না আসায় আসামি ১৯ মে মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেছেন আদালত।

খুনের মামলার বিচারের অগ্রগতি সম্পর্কে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের এডিশনাল পাবলিক প্রসিকিউটর কালাম খান বলেন, কয়েকজন আসামির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় প্রায় ৫ বছর বন্ধ ছিল। এর পর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। বর্তমানে ৯৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। আমরা গত বছর শেষের দিকে দায়িত্ব নিয়েছি। আশা করছি, আগামী বছরের মধ্যে এ মামলার বিচার শেষ করতে পারব।

এদিকে রানা প্লাজার ঘটনায় ৩ মামলার এখনও কোনো সুরাহা না হলেও এ ঘটনার পর রানার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া সম্পদের হিসাব দাখিল না করার মামলায় তিনি ২০১৭ সালের ২৮ আগস্ট ৩ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনের একটি মামলা ও শ্রম আদালতে শ্রমিকদের দায়ের করা আরও ১১টি মামলা বিচারাধীন আছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জন ও তথ্য গোপনের মামলায় সোহেল রানার মা মর্জিনা বেগমের গত বছর ২৯ মার্চ ৬ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

রাজউকের মামলা :

ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে রানা প্লাজা ভবন নির্মাণ করায় ২০১৩ সালের ২৫ এপ্রিল রাজউক ১৩ জনকে আসামি করে সাভার থানায় একটি মামলা দায়ের করে। এ মামলায়ও ২০১৫ সালের ১ জুন পৃথক একটি চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি। এতে রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করা হয়। তাদের মধ্যে ১৭ জনই হত্যা মামলার আসামি।

২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন। চার্জ গঠনের পর আসামিদের মধ্যে ৩ জন চার্জ আদেশ বাতিলের জন্য ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পৃথক ৩টি রিভিশন মামলা দায়ের করেন। রিভিশন মামলাগুলোর ২টি খারিজ হলেও এখনও একটি বিচারাধীন থাকায় সাক্ষ্যগ্রহণ বন্ধ রয়েছে।

দুদকের মামলা :

রানা প্লাজা ভবনে ছয়তলা নির্মাণের অনুমোদন থাকলেও নয়তলা ভবন নির্মাণ করায় ২০১৩ সালের ১৫ জুন দুর্নীতির মামলা করে দুদক। মামলায় রানাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে প্রথম দফায় ২০১৪ সালের ১৬ জুলাই এবং দ্বিতীয় দফায় ২০১৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি চার্জশিট দাখিল করে দুদক। মামলাটিতে ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালত ২০১৭ সালের ২১ মে চার্জ গঠন করেন। এখন মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে।

আসামিদের অবস্থান :

তিন মামলায় মোট আসামি ৪২ জন। এর মধ্যে ৭ জন পলাতক রয়েছেন। তারা হলেন সাভার পৌরসভার সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, সাভার পৌরসভার নগর পরিকল্পনাবিদ ফারজানা ইসলাম, নান্টু কন্ট্রাক্টর, মনোয়ার হোসেন বিপ্লব, রেজাউল ইসলাম, নয়ন মিয়া ও সফিকুল ইসলাম। অন্যদিকে কারাগারে রয়েছেন শুধু ভবন মালিক সোহেল রানা। আসামি আবু বকর সিদ্দিক ও মো. আবুল হাসান মারা গেছেন।

অপর ৩২ জন আসামি জামিনে আছেন। তারা হলেন প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, সাইট ইঞ্জিনিয়ার মো. সারোয়ার কামাল ও ইমারত পরিদর্শক মো. আওলাদ হোসেন, ভবন মালিক সোহেল রানার বাবা আব্দুল খালেক ওরফে কুলু খালেক, সাভার পৌর মেয়র আলহাজ রেফাত উল্লাহ, কাউন্সিলর মোহাম্মাদ আলী খান, উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান রাসেল, নিউওয়েব বাটন লিমিটেডের চেয়ারম্যান বজলুস সামাদ আদনান, নিউওয়েব স্টাইপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুর রহমান তাপস, ইতার টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান ওরফে আনিসুজ্জামান, আত্রিলু ইসলাম, মো. মধু, অনিল দাস, মো. শাহ আলম ওরফে মিঠু, সাভার পৌরসভার তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কমকর্তা উত্তম কুমার রায়, সোহেল রানার মা মর্জিনা বেগম, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের সাবেক উপ-প্রধান পরিদর্শক মো. আব্দুস সামাদ, উপ-প্রধান পরিদর্শক বেলায়েত হোসেন, পরিদর্শক প্রকৌশল মো. ইউসুফ আলী, পরিদর্শক প্রকৌশল মো. মহিদুল ইসলাম, ইতার টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জান্নাতুল ফেরদৌস, মনোয়ার হোসেন বিপ্লব, মো. আতাউর রহমান, মো. আব্দুস সালাম, বিদ্যুৎ মিয়া, সৈয়দ শফিকুল ইসলাম জনি, মো. আব্দুল হামিদ, আব্দুল মজিদ, মো. আত্রিলু ইসলাম, মো. ইউসুফ আলী ও মাহবুল আলম।

চার্জশিটে বলা হয়, রানা প্লাজা তৈরির প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়ম ও জালিয়াতির আশ্রয় নেন ভবনটির মালিক ও তাঁর ছেলে। ভবনের পাঁচটি পোশাক কারখানায় বসানো হয় বৈদ্যুতিক ভারী জেনারেটর, ভারী সুইং মেশিন। রানা প্লাজা ধসের আগের দিন ভবনের তৃতীয় তলায় ফাটল দেখা দিলেও ভবন খালি করা হয়নি। উল্টো পাঁচ পোশাক কারখানার মালিক, ভবনমালিক ও তাদের লোকজন ভয় দেখিয়ে পোশাককর্মীদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেন। ঘটনার দিন সকাল ৯টায় রানা প্লাজায় হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। তখন একসঙ্গে পোশাক কারখানাগুলো তিনটি জেনারেটর চালু করে। এ সময় বিকট শব্দে ভবনটি ধসে পড়ে।