‘তার খোঁজ কেউ কখনো করেছে বলে মনে হয় না’
অভিনেতা, নির্মাতা, লেখক ও চিত্রশিল্পী- এমন অনেক পরিচয়ে পরিচিত আফজাল হোসেন। বৈচিত্র্যপূর্ণ অভিনয় দিয়ে তিনি জয় করেছেন দর্শকদের হৃদয়। এরপর নাম লিখিয়েছেন নির্মাতা হিসেবে। সেখানেও দেখিয়েছেন মুন্সিয়ানা। প্রশংসিত হয়েছেন লেখালেখি ও আঁকাআকিতেও। বেশ কয়েক বছর ধরে গুণী এই অভিনেতা সরব আছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কাজের পাশাপাশি ব্যক্তিজীবন ও নানা মত প্রকাশ করে থাকেন ফেসবুকে।
তারই ধারাবাহিকতায় নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে আফজাল হোসেন লিখেছেন, ‘আমি, আমরা গ্রামে জন্মানো, গ্রামে বেড়ে ওঠা মানুষ। ছোট্ট গ্রামটা ভর্তি ছিল বড় বড় মানুষে। সেই সব মানুষেরা শুধু ভালো মানুষ আর ভালোর গল্প শুনিয়েছে। কি ভালো, কেন ভালো শেখাতো। গ্রামে ভালো ছিল মন্দও ছিল। মন্দ টানত না আমাদের। আনন্দে, প্রেমে, ভালোর আলোয়, সুখে শান্তিতে বড় হতে পেরেছিলাম।’
শৈশবের স্মৃতি স্মরণ করে এই অভিনেতা লিখেছেন, ‘আমরা চোর পুলিশ খেলেছি। খেলার সময়েও কেউ চোর হতে চাইত না। আমরা লুডু খেলায় চুরি করে জিতেছি এবং তা অপরাধ বুঝে রাতে মন খারাপ হতো, চোখে ঘুম আসতো না। দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে যেতাম। আমাদের বড় হওয়া জুড়ে ছিল ঈদের আনন্দ, পূজার বাদ্য, মাহফিলের গজল, আজানের ধ্বনি আর খোল করতাল মন্দিরার সাথে হরিনাম। বাড়ির পশ্চিমদিকে শ্মশান আর বাড়ির পাশ দিয়েই সেখানে যাওয়ার রাস্তা। তাই হরহামেশা দেখতে হয়েছে শ্মশানযাত্রা।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাড়িটার পূর্বদিকে দেয়াল ঘেঁসে মসজিদ ছিল আর মসজিদ থেকে কুড়ি হাত দূরে কালীমন্দির। কালীমন্দিরের মুখোমুখি কবরস্থান। তার কোল ঘেঁষে বাজার আর বাজারের দক্ষিণ দিয়ে নদী বয়ে গেছে পশ্চিমের দিকে। পিছন দিকে ছিল বিশালাকার একটা বটগাছ। সে গাছ সারা বছর ধরে পাখিদের কিচির মিচির বিলিয়ে যেতো গ্রামে। শহরে যাতয়াত করা বাস এসে থামতো বাড়ির সামনে। বাস থামতো বলে রাস্তার পাশে ছিল অনেকগুলো চায়ের দোকান। ভোরবেলা থেকেই সে দোকানগুলোয় অবিরাম বাজা শুরু হয়ে যেতো গ্লাসের ভিতর দ্রুত চামচ নাড়ানোর টুং টাং টুং।’
আরও পড়ুন:
ওটিটি প্ল্যাটফরম আমার জন্য বেশ লাকি
আফজাল হোসেনের কথায়, ‘রাজ্জাক মিস্ত্রির মাইকে বাজতো তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা- সে দুঃখের গান শুনে চায়ের কাপে চুমুক দিতে ভুলে যেতো মানুষ। ঠান্ডা হয়ে যেতো চা। থেমে থাকা বাসে ড্রাইভার উঠে বসলে যাত্রীরা অনুরোধ করতো- গানডা শেষ হলি পরে বাসে স্টার্ট দিয়েন ড্রাইভার সায়েব। রেডিওতে নাটক শুনে কাঁদতো মানুষ। অনুরোধের আসর শুনতো পনেরো-কুড়িজন গোল হয়ে বসে। আমরা গামলায় মুড়ি মেখে নিয়ে বসতাম ছাদে। সে ছাদে ওঠার কোনো সিঁড়ি ছিল না। ওঠার জন্য শক্ত পোক্ত একটা মই ছিল। আম্মা ওঠা নামা ঝামেলা মনে করে রেডিওর সাথে জায়নামাজ সাথে নিয়ে ছাদে উঠতেন। মাগরিবের নামাজ শেষ করে ছাদ থেকে নামা হতো।
ছেলেবেলার স্মৃতি স্মরণ করে এই অভিনেতা আরও বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে জন্ম। আম্মাকে একসময় ডেকেছি আম্মাজান বলে। আব্বাকে ডাকতাম আব্বাজান। তারা ছিলেন নামাজ রোজা পালন করা মানুষ। যখন জানলেন, ক্লাস সেভেনে স্কুল নামাজ পড়া অভ্যাস করিয়েছে খুব খশি হয়েছিলেন দুজনে। ছেলে বড় হয়ে যখন আর্ট কলেজে ভর্তি হতে চাইল, আম্মাজান খুব খুশি হন- সন্তান সুন্দর বিষয় শিখতে চায়। আব্বাজানের আপত্তি ছিল, ছবি আঁকা মানুষের ভালো ভবিষ্যৎ হয় না ভেবে।’
আরও পড়ুন:
নানাকে নিয়ে পরীর আবেগঘন পোস্ট
‘ভর্তি হয়ে গেলাম। স্বাধীনতার আন্দোলনে দেশ হয়ে গেল উত্তাল। তারপর মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীন হয়ে গেল দেশ। পাশ করে বেরিয়ে গেলাম। আব্বা আম্মা শুনতে পান, ছেলে ভালো আঁকে, ভালো অভিনয় করে। জানতে পারেন, দুটোর কোনোটাই ভালো রোজগেরে কাজ নয়। তবু উদ্বিগ্ন হন না তারা। আনন্দে থাকেন, ছেলে ভালো, গৌরব করার মতো কাজে আছে। আম্মাজান আব্বাজান ছেড়ে একসময় আমরা আম্মা-আব্বা ডাকা শুরু করি। আমাদের সন্তানেরা আমাদের ডাকে বাবা-মা। সময়ের বদল। এই সময়ে চারদিকে অনেক ভালো, অনেক অনেক মন্দ। আমরা ওদের বলি না, ওটা ভালো, সেটা মন্দ। ওরা ভালো চিনে ভালোর মধ্যেই বড় হচ্ছে- সেটাতেই তিন ভাই বোনের আনন্দ।’ বললেন আফজাল হোসেন।
আক্ষেপ নিয়ে এই অভিনেতা বলেন, ‘বেদনা হচ্ছে ওদেরকে গ্রামে নিয়ে যাই, বহু পুরানো গল্প শোনাই কিন্তু গল্পের গ্রামটাকে দেখাতে পারি না। সহস্র শব্দ বর্ণ আর গন্ধের মধ্যে আমরা বড় হয়েছি- আমাদের সন্তানদের সেই শব্দ বর্ণ গন্ধের সামান্যও শোনাতে, দেখাতে, অনুভব করাতে পারি না। আমরা এই প্রিয় শহরটাকেও আমাদের ভাষায় বর্ণনা করি। ওরা শোনে আর যা নিজেদের দেখা- তার সাথে মেলানোর চেষ্টা করে।’
সবশেষে আফজাল হোসেন বলেন, ‘বহুকালের পুরাতন বহু ভালো বদলে নতুন ভালো তৈরি করতে চায়, চেয়েছে মানুষ। কতটুকু লাভ বা কি পরিমান লোকসান হয়েছে তাতে, তার খোঁজ কেউ কখনো করেছে বলে মনে হয় না। তবু স্বপ্ন দেখি, আশা আছে। আমাদের পক্ষ থেকে বাংলা নতুন বছরে, সবার জন্য শুভকামনা।’
আরও পড়ুন:
‘এভাবে বিয়ে করা নাকি অর্থহীন’