মডেল মেঘনাকাণ্ডে পদ হারালেন ডিবিপ্রধান
মডেল মেঘনা আলমকে সুনির্দিষ্ট কারণ না জানিয়ে বিতর্কিত বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেপ্তারের ঘটনায় নানা মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন তুলেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালতও। এমন কী তাকে যে প্রক্রিয়ায় আটক করা হয়েছে, তা সঠিক হয়নি বলে গতকাল রবিবার আইন উপদেষ্টাও মন্তব্য করেছেন। এমন প্রেক্ষাপটে মেঘনা আলমকে গ্রেপ্তারের জেরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও ডিবিপ্রধান রেজাউল করিম মল্লিক পদ হারিয়েছেন বলে আলোচনা চলছে। গত শনিবার রাতে সরকার তাকে ডিবি প্রধান থেকে সরিয়ে ডিএমপি সদর দপ্তরে সংযুক্ত করে।
জানা গেছে, ঢাকাস্থ সৌদি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের জেরে গত বুধবার সন্ধ্যায় মেঘনা আলমকে তার বসুন্ধরার বাসা থেকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিলেন ডিবিপ্রধান রেজাউল করিম মল্লিক। আটকের সময় মডেল মেঘনা ফেসবুকে লাইভ করছিলেন। লাইভে তিনি নিজেকে নিরপরাধ দাবি করছিলেন। ফেসবুকে ওই লাইভ চলার মধ্যেই তার বাসার দরজা ভেঙে পুলিশ ভেতরে প্রবেশ করে এবং এর পরই লাইভটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর পরই ১২ মিনিটের বেশি সময় ধরে চলা লাইভটি ডিলিটও হয়ে যায়। যদিও তার আগেই লাইভটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
রাতে আটকের পর বৃহস্পতিবার সারাদিন মেঘনাকে মিন্টো রোড ডিবি অফিসে আটক রেখে রাত ১০ দিকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে তোলা হয়। বিজ্ঞ আদালত তাকে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৩০ দিনের আটকাদেশ দিয়ে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। বর্তমানে মেঘনা কারাগারে রয়েছেন।
মেঘনার আটকাদেশ কেন অবৈধ নয় : হাইকোর্ট
মেঘনা আলমকে পরোয়ানা ছাড়া ও কারণ উল্লেখ না করে গ্রেপ্তার এবং ২৪ ঘণ্টার বেশি গোয়েন্দা কার্যালয়ে হেফাজতে রাখা প্রশ্নে রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে বিশেষ ক্ষমতা আইনে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে মেঘনাকে দেওয়া আটাকাদেশ কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা রুলে জানতে চাওয়া হয়েছে। একটি রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি রাজিক আল জলিল ও বিচারপতি তামান্না রহমান খালিদীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল
এ রুল দেন। এর আগে মেঘনাকে আটকের প্রক্রিয়া ও আটকাদেশের বৈধতা নিয়ে তার বাবা বদরুল আলম রিট আবেদন করেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন। তার সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী কাজী জাহেদ ইকবাল ও প্রিয়া আহসান চৌধুরী। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ও জামিলা মমতাজ।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
রুলে পরোয়ানা ছাড়া বাসা থেকে মেঘনা আলমকে গ্রেপ্তার, কারণ না জানিয়ে গ্রেপ্তার, ডিবি কার্যালয়ে ২৪ ঘণ্টার বেশি হেফাজতে রাখা ও আইনজীবীর সুযোগ না দেওয়া কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিশেষ ক্ষমতা আইনে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে দেওয়া আটকাদেশ কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তাও জানতে চেয়েছেন আদালত। স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) প্রধান, ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ও ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া সঠিক হয়নি : আইন উপদেষ্টা
মেঘনা আলমকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে যে প্রক্রিয়ায় আটক করা হয়েছে, সেটা সঠিক হয়নি বলে গতকাল সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তবে তার বিরুদ্ধে কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে বলে উল্লেখ করেন এই উপদেষ্টা। তিনি বলেন, পুলিশ তদন্ত করছে। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শিগগির উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
আইন উপদেষ্টা বলেন, মেঘনা আলমকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ডিটেনশন দিয়েছিল। এ নিয়ে অনেক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। আপনাদের শুধু একটি জিনিস বলতে চাই- আমরা সরকারের উচ্চপর্যায়ে এ নিয়ে মিটিং করেছি। এ ব্যাপারে বিভিন্ন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান এবং অন্য অনেকের বক্তব্যে সচেতন আছি। আমরা শুধু এটুকু বলতে পারি, মেঘনা আলমের ব্যাপারে পুলিশ কিছু তদন্ত করছে এবং ওনার বিরুদ্ধে কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। কিন্তু ওনাকে যে প্রক্রিয়ায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে, বিশেষ ক্ষমতা আইনে- সেটা সঠিক হয়নি।
আসিফ নজরুল বলেন, মেঘনা আলমের যদি কোনো অপরাধ থাকে, সে অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়াটি ঠিক হয়নি, এটি তারা (সরকার) স্বীকার করছে। কিন্তু গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া ঠিক হয়নি মানে তার বিরুদ্ধে অপরাধের কোনো আলামত বা অভিযোগ নেই, এটা না। সে রকম কিছু আছে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে করণীয় আছে, সেই ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শিগগির উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
পদ হারালেন ডিবি প্রধান
মডেল মেঘনা আলম কা-ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) প্রধানের পদ থেকে রেজাউল করিম মল্লিককে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত শনিবার ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয়ের এক আদেশে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। রেজাউল করিমকে ডিবিপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার আদেশ স্বাক্ষর করেন ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। আদেশে বলা হয়, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) রেজাউল করিম মল্লিককে ডিএমপির সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত প্রশাসনিক স্বার্থে রেজাউল করিম মল্লিককে তার নামের পাশে উল্লেখিত স্থানে পদায়ন করা হলো।
গত বছরের ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর ১ সেপ্টেম্বর ডিএমপির ডিবিপ্রধানের দায়িত্ব পান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিক। ১৭তম বিসিএস (পুলিশ) ব্যাচের কর্মকর্তা রেজাউল ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দেন। ডিএমপির ডিবিপ্রধান হওয়ার আগে তিনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগসহ (সিআইডি) বিভিন্ন ইউনিটে দায়িত্ব পালন করেন।
এদিকে মেঘনার বাবা বদরুল আলমের দাবি, ঢাকায় নিযুক্ত সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত ঈসা বিন ইউসুফ আল দুহাইলানের সঙ্গে তার মেয়ের সম্পর্কের বিষয়ে তিনি কিছু কিছু জানতেন। এই সম্পর্কের জেরে মেঘনাকে আইনের মুখোমুখি হতে হয়েছে বলে দাবি তার। তিনি বলেন, অন্যায়টা করল সৌদি রাষ্ট্রদূত, তার অন্যায়ের বিচার হলো না। কিন্তু মেঘনাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলো। ঈসা বিন ইউসুফ একজন রাষ্ট্রদূত, তিনি সৌদির রয়েল পরিবারের কেউ নয়, তিনি একজন চাকরিজীবী। বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে মেঘনার অধিকার বেশি। অন্য দেশের একজন নাগরিক অন্যায় করে চলে যাবে, তার কোনো বিচার হবে না; এটি ঠিক নয়।
বদরুল আলম আরও বলেন, বিশেষ ক্ষমতা আইনের যে অর্ডার সেটি সঠিক নয়; যে প্রক্রিয়ায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেটিও সঠিক নয়। তাকে ধরার ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় পুলিশি হেফাজতে রাখা হয়েছিল, সেটিও সঠিক নয়। এ ছাড়া যেসব অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে, সেগুলোও সঠিক নয়; এ জন্য হাইকোর্টে রুল জারি হয়েছে।