নতুন শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ল ৩৩ শতাংশ
গ্যাস সংকটে বিপর্যয়ের মধ্যে শিল্প খাত। প্রয়োজনীয় গ্যাসের অভাবে শিল্পকারখানা পুরোদমে চলছে না। নতুন করে শিল্পকারখানার আকার বাড়ানো যাচ্ছে না। নতুন সংযোগ সহজে মিলছে না। নতুন বিনিয়োগও প্রায় স্থবির। গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে যখন গণশুনানি করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি), তখনও পেশাজীবী, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদরা গ্যাসের দাম না বাড়ানোর যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। অথচ ফের গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে কমিশন।
শিল্পকারখানায় অনুমোদিত লোড পর্যন্ত আগের দামই বহাল রাখা হয়েছে; তবে এর বেশি গ্যাস ব্যবহার করলে বাড়তি দাম পরিশোধ করতে হবে। একই সঙ্গে নতুন শিল্পকারখানা করলে বাড়তি গ্যাস বিল পরিশোধ করতে হবে।
শিল্পের বয়লারে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ঘনমিটার প্রতি ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা এবং ক্যাপটিভে ৩১.৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪২ টাকা নির্ধারণ করেছে বিইআরসি। এ ছাড়া বিদ্যমান শিল্পকারখানায় অনুমোদিত লোডের অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহার করলে তার জন্য ৩০ টাকার পরিবর্তে ৪০ টাকা দরে বিল দিতে হবে। নতুন দাম চলতি মাসের বিল থেকেই কার্যকর হবে।
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন দর ঘোষণা করেন বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ। এতে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য মিজানুর রহমান, সদস্য সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া, মো. আব্দুর রাজ্জাক, শাহীদ সারোয়ার প্রমুখ।
বিদ্যমান গ্রাহকদের দাম অপরিবর্তিত রেখে নতুন ও প্রতিশ্রুত গ্রাহকদের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল পেট্রোবাংলা। শতকরা হিসাবে ৩৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। প্রতি ইউনিটে ১০ টাকা বাড়তি দিতে হবে। প্রতিশ্রুত শিল্পগ্রাহকদের অনুমোদিত লোডের ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহারে বাড়তি দাম দিতে হবে। নতুন এ দাম আজ থেকেই কার্যকর হবে। ১৩ এপ্রিলের পর যত গ্যাস সংযোগ অনুমোদন করা হবে, সবারই বাড়তি দাম দিতে হবে। এর আগ পর্যন্ত সংযোগের জন্য যেসব আবেদনের চাহিদাপত্র ইস্যু করা হয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহারে নতুন দাম দিতে হবে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
পেট্রোবাংলার প্রস্তাবে প্রতিশ্রুত গ্রাহকদের (ইতোমধ্যে অনুমোদিত) অর্ধেক বিল বিদ্যমান দরে, অর্ধেক ৭৫.৭২ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়। অন্যদিকে নতুন শিল্প ও ক্যাপটিভে গ্যাসের দাম যথাক্রমে ৩০ ও ৩১.৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫.৭২ টাকা করার কথা বলা হয়েছিল।
পেট্রোবাংলার দাম
বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর ২৬ ফেব্রুয়ারি শুনানি গ্রহণ করে বিইআরসি। পেট্রোবাংলা প্রস্তাবে বলেছে, দাম না বাড়ালে বছরে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হবে। পেট্রোবাংলার প্রস্তাব নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। শুনানিতেও ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা তীব্র আপত্তি তোলেন। বিশেষ করে শিল্পে দুই ধরনের দরের বিরোধিতা করেন সবাই। তারা বলেছেন, বিদ্যমান শিল্প বিদ্যমান দামে আর নতুন শিল্পের জন্য বাড়তি দাম নির্ধারণ করা হলে অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হবে।
কী পদ্ধতিতে বা কী ধরনের হিসাবের প্রেক্ষিতে দাম বাড়ানো হলো- এ প্রশ্নে বিইআরসির চেয়ারম্যান বলেন, রাজস্ব চাহিদা ধরলে দাম অনেক বেশি বাড়াতে হতো। তাই ভোক্তার জন্য সহনীয় রাখতে ৩৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভর্তুকিরও হিসাব করা হয়নি। রাজস্ব চাহিদা যাচাই ছাড়া এভাবে মূল্যবৃদ্ধি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে করা হয়েছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের প্রেসক্রিপশনে করা হয়নি।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
নতুন ও পুরনো শিল্পে আলাদা দাম রেখে যে বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে, এটা আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে কি না- এ প্রশ্নে চেয়ারম্যান বলেন, বিইআরসির আইনি আওতার মধ্যে থেকেই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিনিয়োগ কমার বিষয়টা এখনই বলা যাবে না। নতুন যারা আসবে, তারা যদি দেখে তাদের পোষাবে, তাহলে তারা আসবে। তারা বিকল্প জ্বালানিও ব?্যবহার করতে পারে।
দাম ঘোষণার সময় বলা হয়- শুনানিতে অংশগ্রহণকারীরা মূল্যবৃদ্ধির বিরোধিতা করে সিস্টেম লস কমাতে বলেছিল। এটা দ্রুত কমানো খুব কঠিন। এ নিয়ে তাগাদা দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে সব কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন মূল্যায়ন করা হবে। পেশাদার নিরীক্ষক নিয়োগ করে আয়-ব্যয়ের যথার্থতা যাচাই করা হবে। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি আমদানি বাড়াতে বলা হয়েছে।
এদিকে ক্যাবের জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বলেছেন, গণশুনানিতে আমরা হিসাব করে দেখিয়েছি দাম কমানো যায়। বিগত সরকার যেসব লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বাড়িয়েছে, দাম বাড়ানো হলে ভোক্তাদের সুরক্ষা না দিয়ে সেই লুণ্ঠনমূলক ব্যয়ের দায়ভার তারা কাঁধে তুলে নিলেন বলে প্রমাণিত হবে। একই দেশে শিল্পে দুই ধরনের দর আইনের দৃষ্টিতে অচল। তাই চ্যালেঞ্জ করার কথাও জানিয়েছেন তিনি।
পেট্রোবাংলা কয়েকটি উৎস থেকে গ্যাস কিনে থাকে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি ও বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানিকে প্রতি হাজার ঘনফুটের দাম দেওয়া হয় ২৮ টাকার মতো, আর বাপেক্সকে দেওয়া হয় ১১২ টাকার মতো। দেশের খনি থেকে গ্যাস উত্তোলন করা বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশকে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম দেওয়া হয় ২.৭৬ ডলার, আর টাল্লোকে দেওয়া হয় ২.৩১ ডলার। অন্যদিকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে কাতার থেকে আমদানি করা এলএনজির দাম ১০.৬৬ ডলার ও ওমান থেকে আনা এলএনজির দাম পড়েছে ১০.০৯ ডলার। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কয়েক দশকের স্থবিরতার কারণে আমদানির দিকে যেতে হয়েছে। অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করা না হলে ভবিষ্যতে পরিস্থিত ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে শিল্পে ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয় গ্যাসের দাম। শিল্প ও ক্যাপটিভে প্রতি ইউনিটের দাম রাখা হয় ৩০ টাকা। গত বছর ক্যাপটিভে দাম বাড়িয়ে করা হয় ৩১.৫০ টাকা।
এদিকে দাম বাড়ানোর কিছু প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা করেছেন তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (তিতাস) কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, একই শিল্পে একই মিটারে আলাদা আলাদা বিল তৈরি করা চ্যালেঞ্জিং হবে। সফটওয়ার ডেভেলপমেন্ট না করে এটা ঠিকভাবে করা যাবে না। তিতাসের এক কর্মকর্তা বলেন, এখনও তিতাসের কাছে সঠিক হিসাব নেই কোনটা ভারী, কোনট মাঝারি, কোনটা বৃহৎ শিল্প। ফলে বিল প্রণয়নে তিতাসসহ বিতরণ কোম্পানিগুলো জটিলতায় পড়তে পারে।