জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর মহাপরিকল্পনা পুনর্বিবেচনার দাবি
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো ঢাকায়ও জলবায়ু ধর্মঘট পালন করেছে দেশের তরুণ জলবায়ু কর্মীরা। ধর্মঘটে সমন্বিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মহাপরিকল্পনা (আইইপিএমপি) বাস্তবায়ন হলে ব্যয়বহুল ও দূষিত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার আরও বাড়বে মন্তব্য করে এটি দ্রুত সংশোধনের দাবি জানানো হয়েছে।
আজ শুক্রবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক সমাবেশে এ দাবি জানান তারা। বর্তমান পরিকল্পনা জলবায়ু লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং এর ফলে দেশের জলবায়ু সংকট আরও গভীর হতে পারে বলে তারা গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে।
বৈশ্বিক জলবায়ু ধর্মঘটের অংশ হিসেবে আয়োজিত এই সমাবেশে ২শ জনেরও বেশি তরুণ জলবায়ু কর্মী রঙিন ব্যানার, পোস্টার ও স্লোগানের মাধ্যমে জীবাশ্ম জ্বালানির ক্ষতিকর প্রভাব তুলে ধরেন। “ভুয়া সমাধান নয়, নবায়নযোগ্য শক্তি চাই” শীর্ষক শ্লোগানে মুখরিত ছিল সমাবেশস্থল। জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট তুলে ধরে তারা বলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টেকসই ও বাসযোগ্য বাংলাদেশ গড়তে হলে জ্বালানি নীতিতে নবায়নযোগ্য উৎসগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে জীবাশ্ম জ্বালানি-নির্ভর বিদ্যুতে বিশ্বের উন্নত দেশ এবং বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগ বন্ধ করতে হবে। সমাবেশে জলবায়ুকর্মীরা বলেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে অবশ্যই বহুজাতিক ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকেও গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে জলবায়ু ও পরিবেশের জন্য ইতিবাচক আখ্যা দিয়ে জলবায়ু কর্মীরা বলেন, দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে নতুন সরকারকে কাজ করতে হবে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জলবায়ু সম্মেলনে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দূষণকারী উন্নত দেশগুলোকে বাংলাদেশকে সহায়তা দেবার জোর দাবি জানানো হয় সমাবেশে। একইসাথে বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর জলবায়ু ঋণ নিঃশর্ত মওকুফের দাবি জানিয়েছেন তরুণ জলবায়ু কর্মীরা। আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বৈশ্বিক জলবায়ু ধর্মঘটের অংশ হিসেবে একই দিনে দেশের ৫০টি জেলায় একযোগে কর্মসূচি পালিত হয়েছে। এতে দেশের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়।
সমাবেশে ইয়ুথনেট গ্লোবাল এর নির্বাহী সমন্বয়ক সোহানুর রহমান বলেন, ‘জলবায়ু সংকটকে বিবেচনায় রেখে আমাদের শক্তি পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। আইইপিএমপিতে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সুবিধা নিশ্চিত করার বদলে দরকার একটি ন্যায্য, স্বচ্ছ ও স্থানীয় বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটানো পরিকল্পনা। এখন সময় জনগণকে ক্ষমতায়িত করা, নবায়নযোগ্য শক্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং ভ্রান্ত সমাধানের যুগের অবসান ঘটানোর।’
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ভবিষ্যৎ জীবাশ্ম জ্বালানির মুনাফার জন্য বিক্রি করা চলবে না। নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসারই একমাত্র টেকসই পথ।’
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব থেকে পৃথিবীকে রক্ষায় ২০১৮ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী বৈশ্বিক জলবায়ু ধর্মঘট পালন করে আসছেন সারাবিশ্বের তরুণ জলবায়ু কর্মীরা। মূলত এই ধর্মঘটের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধ ও ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়ে বিশ্বনেতাদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তারা। বৈশ্বিক পর্যায়ে স্কুল শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত সংগঠন ‘ফ্রাইডেস ফর ফিউচার’ এ ধর্মঘটের মূল উদ্যোক্তা। ফ্রাইডেস ফর ফিউচারের সঙ্গে সমন্বয় করে বাংলাদেশে প্রতিবছর জলবায়ু ধর্মঘটের আয়োজন করে আসছে তরুণদের সংগঠন ইয়ুথনেট গ্লোবাল।
তরুণ জলবায়ু কর্মীরা জানান, আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনে উন্নত দেশগুলোর দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাংলাদেশকে সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য দেওয়া জলবায়ু ঋণ নিঃশর্তভাবে মওকুফ করতে হবে।
জলবায়ু কর্মী আরুবা ফারুক বলেন, “জলবায়ু সংকটে দায়ী নয় বাংলাদেশ, অথচ ক্ষতির শিকার আমরা। তাই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে উন্নত দেশগুলোকে।”
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
তরুণদের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “আইইপিএমপি বিগত সরকারের একটি ভুল পরিকল্পনার অংশ, যা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের আর্থিক সংকটকে উপেক্ষা করেছে। এ পরিকল্পনায় বিদ্যুতের চাহিদা অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষিতভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, যার সুযোগ নিয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলো।”
তিনি আরও বলেন, “রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এখনই সময় আইইপিএমপি পুনঃমূল্যায়ন ও সংশোধনের। আমরা চাই নতুন পরিকল্পনা হবে দেশীয় সমাধানভিত্তিক, দেশীয় অর্থায়নে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে প্রণীত।”
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, “আইইপিএমপিতে নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণের কোনো সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন নেই। কোন বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কত কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে, সেটির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। একই সঙ্গে রিনিউয়েবল এনার্জি পলিসি ২০২৫-এর সঙ্গে সমন্বয় করে আইইপিএমপিকে সংশোধন করতে হবে।”
কর্মসূচি থেকে তরুণেরা বাংলাদেশকে জলবায়ুবান্ধব, নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর মহাপরিকল্পনা তৈরি এবং তা বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জোরালো আহ্বান জানান।