বড় ঝুঁকিতে বাংলাদেশ
বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। ভৌগোলিক কারণেই এই ঝুঁকির আশঙ্কা। কম মাত্রার একাধিক ভূমিকম্প দিন দিন বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা প্রকট করে তুলছে। জানা গেছে, উপরিতলের বাংলাদেশ সমতল ভূমি হলেও টেকটোনিক প্লেটের হিসেবে বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত শস্য-শ্যামল এই সমতল ভূমি। রয়েছে একাধিক ফল্টও। এসব কারণে বাংলাদেশকে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একসময় পৃথিবীর সব স্থলভাগ একত্রে ছিল। উপরিভাগের প্লেটগুলো ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে গেছে। এই প্লেটগুলোকেই বিজ্ঞানীরা বলেন টেকটোনিক প্লেট। এগুলো একে অপরের সঙ্গে পাশাপাশি লেগে থাকে। কোনো কারণে এগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ হলেই তৈরি হয় শক্তি। এই শক্তি সিসমিক তরঙ্গ আকারে ছড়িয়ে পড়ে। তরঙ্গ শক্তিশালী হলে সেটি পৃথিবীর উপরিতলে এসে পৌঁছায়। আর পৌঁছানোর পর শক্তি অটুট থাকলে সেটা ভূত্বককে কাঁপিয়ে তোলে। এই কাঁপুনিই ভূমিকম্প। এই প্লেটের নানা ভূগর্ভস্থ চ্যুতি আছে। সেগুলোই ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত।
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বের সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকা এবং হিমালয়ের পাদদেশের এলাকাগুলো ভূমিকম্পপ্রবণ। এসব স্থানে ভূমিকম্প বাড়ছে। এর প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশে।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার বলেন, কাঠের টুকরার দুই পাশে যদি ক্রমাগত চাপ দেওয়া হয়, তবে এর ভেতরে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়। একসময় উভয়মুখী চাপে কাঠটি চিড়ে বা ফেটে যেতে পারে। বাংলাদেশের আশপাশে যেসব ভূমিকম্প হচ্ছে, সেটা এখন কাঠের চিড়ে যাওয়ার অবস্থায় আছে। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের জৈন্তাপুর চরম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় একটি উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প ঢাকায় অকল্পনীয় মাত্রার বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ঢাকার ঘনবসতি, পুরনো অবকাঠামো এবং বিল্ডিং কোডের দুর্বল প্রয়োগ বিপদগুলোকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, অনেক বড় বড় অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে ঢাকায়। হতে পারে সেগুলো অনেক নিয়ম মেনে করা হচ্ছে। কিন্তু যখন বড় মাত্রার ভূমিকম্প হবে, তখন হিসাব-নিকাশ ওলট-পালট হয়ে যাবে অনেক ক্ষেত্রেই। রাজউক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ অনেক ভবনের তালিকা করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দৌড়টা হচ্ছে তালিকা পর্যন্তই। পরে এর কোনো তদারকি নেই। তিনি বলেন, অনেক সরকারি স্থাপনা, স্কুল, হাসপাতাল এসব প্রতিষ্ঠানও ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে। কিছু কিছু জায়গায় তো ভূমিকম্প ছাড়াই ভবন ধসে যাচ্ছে। এমনিতেই অনেক ঝুঁকি রয়েছে, তার মধ্যে যদি ভূকম্পন হয়, তাহলে না আছে পর্যাপ্ত উদ্ধার ব্যবস্থা, না আছে খালি জায়গা। এ ছাড়া গ্যাস-বিদ্যুতের ঝুঁকিপূর্ণ সংযোগ থেকেও ভূমিকম্পের সময় আরও বড় দুর্ঘটনা হতে পারে। সব মিলিয়ে ঢাকা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ একটা শহর।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা শহরের ৭৬ শতাংশ রাস্তা সরু হওয়ায় ভূমিকম্প হলে উদ্ধার তৎপরতা চালানো কঠিন হয়ে যাবে। তা ছাড়া ৬০ শতাংশ ভবন মূল নকশা পরিবর্তন করে করায় বড় ভূমিকম্পে এই অপরিকল্পিত ভবনগুলো ধসে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইনে বিস্ফোরণ ঘটে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। সেক্ষেত্রে ভূমিকম্প অসহনশীল ভবনগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সংস্কার বা ধ্বংসের পরিকল্পনা করা হলেও তার বাস্তবায়ন নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশের মধুপুর ফল্ট, ডাউকি ফল্ট এবং চট্টগ্রামের টেকটোনিক মুভমেন্টের কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৭.৫ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
জানা গেছে, গত ৫০ বছরে (১৯৭৫-২০২৫) বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। তবে সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা কঠিন, কারণ ছোট মাত্রার ভূমিকম্পগুলো প্রায়শই নথিভুক্ত হয় না। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশেই ছিল। ২০২৩ সালের ২ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলায় ৫ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ২২ নভেম্বর চট্টগ্রামে ৬ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল, যা শহরের নানা স্থাপনায় ফাটল ধরায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অঞ্চলের ইতিহাসেও বড় ধরনের ভূমিকম্পের অস্তিত্ব রয়েছে। ১৮৯৭ সালের শিলং প্লেটের ভূমিকম্প তার মধ্যে অন্যতম। মেঘালয়ে উৎপন্ন ৮ দশমিক ৪ মাত্রার এই ভূমিকম্প ঢাকাসহ দেশের বিশাল এলাকায় প্রভাব ফেলেছিল। এর আগে ১৮৮৫ সালে মধুপুর ফল্টে ৭ মাত্রার বেশি শক্তিশালী একটি ভূমিকম্প হয়। যা বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকায় তা-ব চালায়। এ ছাড়া ১৯১৮ সালে সিলেটে একটি বড় ভূমিকম্প হয়। বর্তমানে ভূমিকম্পের ঝুঁকি আরও বেড়েছে। দেশের মধুপুর ফল্ট, ডাউকি ফল্ট এবং চট্টগ্রামের টেকটোনিক মুভমেন্টের কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৭.৫ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে পুরান ঢাকার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ভবন ধ্বংস হয়ে যাবে। পাশাপাশি অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও দুর্বল অবকাঠামো পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। এ বিষয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা এবং মডেল না থাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ পূর্বেই নির্ধারণ করা কঠিন।