যেভাবে জুলাই-আগস্টে বন্ধ হয়েছিল ইন্টারনেট
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল ও অভূতপূর্ব ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে ইন্টারনেট সেবা বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছিল। সেই ইন্টারনেট সেবা কীভাবে বন্ধ হয়েছিল, কারা ছিলেন নেপথ্যে, কেন আদেশ মানতে বাধ্য হয়েছিল দেশের মোবাইল অপারেটর ও আএসপিরা, সেই রহস্য এখন পর্যন্ত পুরেপুরি উন্মোচিত হয়নি। এমনকি অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এ সংক্রান্ত একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও সেই কমিটির রিপোর্টেও স্পষ্ট হয়নি কোন কিছুই। তবে সে সময়ে দেওয়া সরকারি আদেশ এবং একাধিক মাধ্যমে অনুসন্ধানে প্রকৃত কারণ উঠে এসেছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আসা তিন-চারটি ধাপে অপারেটরদের কাছে পৌঁছেছিল। ইন্টারনেট বন্ধ করার মূল লক্ষ্য ছিল দেশে তরুণদের আন্দোলনের খবর চেপে রাখা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, মাঝে মাঝে ইন্টারনেট সেবা সচল হলেও সে সময়ে, দেশের মানুষ ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকসহ জনপ্রিয় অনেক প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করতে পারছিল না। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের বিবৃতিতে এই ঘটনা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। কখনো বলা হচ্ছিল যে এটি এমনিতেই ঘটেছে, আবার কখনো এই ঘটনার জন্য জন্য দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনকে দায়ী করা হয়েছিল। তবে এসব পরবর্তীতে মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়।
গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে জিজ্ঞাসাবাদের সময় সাবেক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক স্বীকার করেন যে, ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল। ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের জন্য যেসব কারণ তখন দেখানো হয়েছিল সেসব সবই ছিল সাজানো ও মিথ্যা।
যেভাবে বন্ধ হয়েছিল ইন্টারনেট: অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ইন্টারনেট সীমিতকরণ শুরু হয় ১৫ জুলাই থেকে, যখন মোবাইল অপারেটররা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে ইন্টারনেট সেবা সীমিত করে। জাতীয় টেলিযোগাযোগ মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) নির্দেশে, ১৭ জুলাই ২০২৪ থেকে মোবাইল অপারেটররা সম্পূর্ণভাবে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। আর এটির নির্দেশনা দেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী বলে জানা যায়।
১৮ জুলাই পলক আগারগাঁওয়ের আইসিটি টাওয়ারে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আন্দোলন কেন্দ্রিক অনিশ্চিত পরিস্থিতির কারণে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে, আমরা দ্রুত সংযোগ পুনরুদ্ধার করব।‘
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
ওই নির্দেশের পর বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সমস্ত গেটওয়ে অপারেটরদের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করার নির্দেশ দেয়।
বিটিআরসি প্রথমে সমস্ত আইটিসি অপারেটরের সাথে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করে এওই গ্রুপে দেওয়া নির্দেশনা অনুসরণ করার জন্য আইটিসি অপারেটদের নির্দেশ দেয়। নির্দেশনা পালন না করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়য়ারও হুমকি দেয় বিটিআরসি। দেশে এই অপারেটরদের মাধ্যমেই জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর কনটেন্টসহ পাইকাড়ি বাজারে ইন্টারনেট আমদানি করা হয়। বিটিআরসি আইটিসি অপারেটরদের সঙ্গে গ্রুপ কলে সম্পূর্ণ আইটিসি সেবা বন্ধ করার জন্য নির্দেশনা জারি করে। একই ধরনের নির্দেশ বিটিসিএল (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেড) এবং বিএসসিপিএলসি (বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল পিএলসি)-কোম্পানিকেও দেওয়া হয়।
একই দিনে, বিটিআরসি সমস্ত আইআইজি (ইন্টার ন্যঅশনাল গেটওয়ে) অপারেটরদের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। আইআইজি অপারটররা মূলত সামেরিন কেবল কোম্পানি ও আইটিসি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ব্যান্ডউইথ কিনে দেশের আইএসপি অপারেটরদের কাছে বিক্রি করে।
এই অপারেটররা হচ্ছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেড, বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেড, উইন্ডস্ট্রিম কমিউনিকেশন লিমিটেড, লেভেল৩ ক্যারিয়ার লিমিটেড, সামিট কমিউনিকেশনস লিমিটেড, স্টারটেক টেলিকম লিমিটেড, স্কাইটেল কমিউনিকেশন লিমিটেড, গ্রীনম্যাক্স টেকনলজিস লিমিটেড, রেগো কমিউনিকেশনস লিমিটেড, ভেলোসিটি নেটওয়ার্কস লিমিটেড, গ্লোবাল ফেয়ার কমিউনিকেশনস লিমিটেড, নোভোকম লিমিটেড, ম্যাঙ্গো টেলিসার্ভিসেস লিমিটেড, এডিএন ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে লিমিটেড, বিডি লিংক কমিউনিকেশন লিমিটেড, রেডিয়েন্ট কমিউনিকেশনস লিমিটেড, ডেলটা ইনফোকম লিমিটেড, সাইবারগেট লিমিটেড, ইকুইটেল কমিউনিকেশন লিমিটেড, করোনেট কর্পোরেশন লিমিটেড, ইন্ট্রাগ্লোবাল কমিউনিকেশনস লিমিটেড, আমরা টেকনোলজিস লিমিটেড এবং ফাইবার@হোম গ্লোবাল লিমিটেড।
মূলত আইআইজিরা বিটিআরসির নির্দেশ মানতে বাধ্য হওয়ার কারণে সব আইএসপি অপারেটরের নেটওয়ার্ক ব্যান্ডউইথ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং ইন্টারনেট সেবা পুরোপুরি অচল হয়ে যায়।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
অন্যদিকে, একই ধরনের নির্দেশনা মোবাইল অপারেটরদের ক্ষেত্রেও জারি করে বিটিআরসি। অবশ্য ১৮ জুলাই বিটিআরসির ওই নির্দেশনা জারির একদিন আগে থেকে অর্থাৎ ১৭ জুলাই থেকেই ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রেখেছিল।
পরবর্তী ঘটনাক্রম: ২৩ জুলাই ২০২৪, বিটিআরসি বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি, সকল আইটিসি অপারেটর, আইআইজি এবং আইএসপি অপারেটরদের সঙ্গে একটি সভা আয়োজন করে। এই সভায়, আইটিসি এবং সাবমেরিন ক্যাবল অপারেটরদের সেবা পুনরায় চালু করার নির্দেশ দেওয়া হয়। আইএসপিদের জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ সেবা, যেমন হাসপাতাল, কূটনৈতিক অঞ্চল, আদালত, দূতাবাস, বিমানবন্দর, ব্যাংক, বিদ্যুৎ ও গ্যাস অফিস এবং রেলওয়ে স্টেশনসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সেবা প্রদান করার জন্য সীমিত ইন্টারনেট অ্যাক্সেস দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। আইএসপিরা তাদের নিজ নিজ আইআইজি-এর সাথে সমন্বয় করে এই সেবা প্রদান করতে থাকে, যার ফলে কিছু এলাকায় ন্যূনতম ইন্টারনেট অ্যাক্সেস পুনরুদ্ধার হয়।
২৪ জুলাই ২০২৪, বিটিআরসি আইআইজি অপারেটরদের ইন্টারনেট সেবা পুনরুদ্ধারের নির্দেশ দেয়, তবে ইউটিউব, ফেসবুক এবং টিকটক এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো বাদ রাখা হয়।
পরদিন, ইউটিউব অ্যাক্সেস পুনরায় চালু করা হয়। ২৮ জুলাই ২০২৪-এর মধ্যে, মোবাইল ইন্টারনেট সেবা সম্পূর্ণরূপে পুনরুদ্ধার হয়, এবং বিটিআরসি-র নির্দেশনায় ৩১ জুলাই ২০২৪-এর মধ্যে ব্রডব্যান্ড সেবা, যার মধ্যে সকল সামাজিক মাধ্যম অন্তর্ভুক্ত ছিল, আইআইজি অপারেটরদের মাধ্যমে পুনরায় চালু হয়।
এরপর আবারও তৎকালীন সরকারের নির্দেশে মোবাইল অপারেটররা আবারও ইন্টারনেট সেবা স্থগিত করে। তবে আইএসপিদের ইন্টারনেট সেবা সীমিত আকারে চালু ছিল। এর পরের দিন ৫ আগস্ট সকালে বিটিআরসির নির্দেশে আইটিসি এবং আইআইজি অপারেটরদের মাধ্যমে ব্রডব্যান্ড সেবাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে কিছুক্ষণ পরই তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলে বিকেলের মধ্যে সমস্ত ইন্টারনেট সেবা পুনরুদ্ধার করা হয়।
ইন্টারনেট বন্ধের এই ঘটনাক্রম পর্যালোচনায় স্পষ্ট হয় যে, বাংলাদেশে সরকার যে কোন সময় ইন্টারনেট বন্ধের পদক্ষেপ নিতে পারে তার আইনি কাঠামো এখনও বিদ্যমান আছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন, ২০০১-এর ৯৭ ধারা অনুযায়ী সরকার যুদ্ধ বা অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার সময় টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখে। ফলস্বরূপ, সমস্ত মোবাইল এবং ব্রডব্যান্ড অপারেটররা বিদ্যমান আইন অনুসরণ করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) দ্বারা জারি করা নির্দেশনাগুলো মানতে বাধ্য হয় এবং সেটাই ঘটেছিল ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, যেহেতু সরকার বিভিন্ন খাতে সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তাই ইন্টারনেট শাটডাউন সংক্রান্ত বিদ্যমান আইনগুলো পুনঃমূল্যায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। জাতীয় নিরাপত্তার প্রয়োজনে এবং নাগরিকদের মৌলিক সেবা ও তথ্য পাওয়ার অধিকার এর মধ্যে সমন্বয় সাধন করে এই বিধিমালার পর্যালোচনা করা অত্যাবশ্যক, বিশেষ করে আজকের সংযুক্ত বিশ্বের প্রেক্ষাপটে।