আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে নজর সরকারের
নতুন দুটি আইন হচ্ছে ।। সংশোধন হচ্ছে ছয় আইন
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশের আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব ছিল। এই সুযোগে প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে কাজ করেছে, তাতে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং সর্বত্রই খারাপ অবস্থা বিরাজ করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি বের করতে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করে।
অর্থনীতি নিয়ে সরকারের শ্বেতপত্রে দেশের অর্থ লুুটপাটের চিত্র উঠে আসে। সেখানে দেখা গেছে, উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রায় পৌনে ৩ লাখ কোটি টাকা অপচয় বা নষ্ট হয়েছে। গত ১৫ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাধ্যমে খরচ করা হয়েছে প্রায় ৭ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এর ৪০ শতাংশ পর্যন্ত লুটপাট করা হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পে মূলত রাজনৈতিক চাঁদাবাজি, ঘুষ এবং বাড়তি খরচ দেখিয়ে এই বিপুল অর্থ লুটপাট করেছেন তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা ও সুবিধাভোগীরা। হাসিনা সরকারের পতনের পর অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষত বেরিয়ে আসছে। বিশেষত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ব্যাপকভাবে। অনেক ব্যাংক পড়েছে তারল্য সংকটে। সাবেক সরকার অর্থনীতির একাধিক সূচক কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেখানোর ফলে প্রকৃত পরিস্থিতি বোঝা যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে সরকার আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ইতোমধ্যে ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন করা হয়েছে। সংস্কার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নতুন আইন প্রণয়ন এবং পুরনো আইনগুলো সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই আইনগুলো তৈরি ও সংশোধনের কাজ শেষ হলে তা আর্থিক খাতের ভিত্তিকে মজবুত ও শৃঙ্খলায় আনবে বলে মনে করা হচ্ছে।
অর্থ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে দুটি নতুন আইন প্রণয়নসহ ৬ আইন সংশোধন হচ্ছে। আইন দুটির একটি হচ্ছে ‘ব্যাংক রেগুলেশন অ্যাক্ট ২০২৫’ (বাস্তবায়নকাল : ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল) এবং অপরটি হচ্ছে ‘ডিসট্রেসড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট’ (২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৬ সালের জুন সময় কালের জন্য)।
সূত্র জানায়, ‘ব্যাংক রেগুলেশন অ্যাক্ট ২০২৫’-এর চূড়ান্ত খসড়া ইতোমধ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে এবং খসড়ার ওপর অংশীজনদের মতামত গ্রহণের জন্য তা বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। অন্যদিকে ‘ডিসট্রেসড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট’-এর খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে এবং খসড়ার ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত পাওয়া গেছে। মতামতের ভিত্তিতে একটি সভা হয়েছে, আরেকটি সভা দ্রুত করা হবে।
এ ছাড়া ৬টি আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- ব্যাংক আমানত বীমা (সংশোধন) আইন। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) আইন; বীমা আইন ২০১০। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইন ২০১০ এবং বীমা করপোরেশন আইন ২০১৯ সংশোধন। মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি আইন ২০০৬ ও মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি বিধিমালা ২০১০ সংশোধন; প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক আইন ২০১০ যুগোপযোগীকরণ এবং গ্রামীণ ব্যাংক আইন সংশোধন।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
ব্যাংক আমানত বীমা (সংশোধন) আইন (২০২৪ সালের ডিসেম্বর-২০২৫ সালের এপ্রিল) : ব্যাংক রেগুলেশন অ্যাক্ট এর কিছু কিছু ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ব্যাংক আমানত বীমা (সংশোধন) আইনটি অধিকতর যাচাই করে অধ্যাদেশ আকারে খসড়া প্রণয়ন করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৫৮ থেকে ১০০ ধারা সংশোধনের প্রয়োজন হতে পারে।
এ ছাড়াও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) আইন সংশোধন (অক্টোবর ২০২৪-ডিসেম্বর ২০২৫) : আইনের খসড়াটি বিএসইসি পুনরায় পর্যালোচনা করার পর পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সেটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠাবে।
বীমা আইন ২০১০, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইন ২০১০ এবং বীমা করপোরেশন আইন ২০১৯ সংশোধন (ডিসেম্বর ২০২৪-ডিসেম্বর ২০২৫) : এ দুটি আইন সংশোধনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি আইন ২০০৬ ও মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি বিধিমালা ২০১০ সংশোধন (অক্টোবর ২০২৪-ডিসেম্বর ২০২৬) : সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর গত ডিসেম্বরে অংশীজনদের সঙ্গে প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ আলোচনা শেষে তা বোর্ডসভায় উপস্থাপন করা হবে। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক আইন ২০১০ যুগোপযোগীকরণ (ডিসেম্বর ২০২৪-ডিসেম্বর ২০২৫) : আইনটির খসড়া প্রণয়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
গ্রামীণ ব্যাংক আইন সংশোধন (ডিসেম্বর ২০২৪-ডিসেম্বর ২০২৫) : ইতোমধ্যে আইনটির সংশোধিত খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে এবং অংশীজনদের নিয়ে গত ডিসেম্বরে একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রাপ্ত মতামতের ভিত্তিতে আইন সংশোধন করে চূড়ান্ত খসড়া প্রণয়ন করা হচ্ছে।
এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিচালক নিয়োগ নীতিমালা সংশোধন। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের কর্মচারী (অনূর্ধ্ব ডিজিএম) নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের সাংগঠনিক কাঠামো সংশোধন/সংস্কারের (রূপালী-জনতা-বেসিক-রাকাব) কার্যক্রমও চলমান রয়েছে।
জানা গেছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিচালক নিয়োগ নীতিমালা সংশোধন (অক্টোবর ২০২৪-মার্চ ২০২৫- জুন ২৫) : গত বছর ৯ এপ্রিল আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপন জারির পর বিশ্বব্যাংক কর্তৃক গত বছর ১৬ এপ্রিল পুনরায় কতিপয় পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়। বর্তমানে বিশ্বব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ-অর্থ বিভাগ-বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সম্মিলিত কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের কর্মচারী (অনূর্ধ্ব ডিজিএম) নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন (অক্টোবর ২০২৪-সেপ্টেম্বর ২০২৫) : অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নে ইতোমধ্যে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির কাছ থেকে খসড়া পাওয়ার পর পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করা হবে।
এ ছাড়াও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের (রূপালী-জনতা-বেসিক-রাকাব) সাংগঠনিক কাঠামো সংশোধন/সংস্কার (ডিসেম্বর ২০২৪- ডিসেম্বর ২০২৫): ইতোমধ্যে রূপালী ব্যাংকের সাংগঠনিক কাঠামো সংশোধন করে গত ডিসেম্বরে পরিপত্র জারি করা হয়েছে। জনতা-বেসিক-রাকাবের সাংগঠনিক কাঠামো সংশোধন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।