সংস্কার-নির্বাচন টানাপড়েন

শাহজাহান মোল্লা
১৮ মার্চ ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
সংস্কার-নির্বাচন টানাপড়েন

অল্প সংস্কার চাইলে চলতি বছর ডিসেম্বরে এবং বেশি সংস্কার হলে আগামী বছর জুনের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে বলে অন্তর্বর্তী সরকার পরিষ্কার বার্তা দিয়েছে। অন্যদিকে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এ বছরের মধ্যেই নির্বাচন দিতে সরকারকে চাপ দিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশনও ডিসেম্বরকে টার্গেট করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন ও সংস্কার চলতে পারে সমান্তরালভাবেই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে নির্বাচন ও সংস্কার দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং নির্বাচন আর সংস্কার সমান্তরালভাবেই চলতে পারে। কিছু সংস্কার অধ্যাদেশ জারি করে আর কিছু সংস্কার প্রশাসনিক আদেশের মাধ্যমে জারি করে নির্বাচনে যেতে বাধা দেখছেন না বিশ্লেষকরা। তবে সরকার চাইছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যে সরকার পরিবর্তন হয়েছে, তাতে পুরো রাষ্ট্রকাঠামোতে পরিবর্তন আনা দরকার। অতীতে বারবার সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় এবার আর সুযোগ হারাতে চায় না সরকার। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় গেলে অঙ্গীকার ভুলে যায় এমন নজির রয়েছে। তাই এবার কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর একমত হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছে সরকার। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বিভিন্ন খাতের সংস্কার কমিশনের সুপারিশ পাঠিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

এসব সুপারিশের মধ্যে কোনটিতে রাজনৈতিক দলগুলো একমত আর কোনটিতে দ্বিমত রয়েছে তা লিখিত আকারে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে দিলে এর পর সেই মতামত নিয়ে কাজ করবে কমিশন। সেখানে কতগুলো সুপারিশ নির্বাচনের আগে আর কতগুলো নির্বাচনের পরে হবে তার একটি পূর্ণাঙ্গ চার্টার হবে, যেটিকে জুলাই চার্টার নাম দিয়েছে সরকার। এই জুলাই চার্টারের ওপর নির্ভর করছে কবে নির্বাচন হবে।

এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো কিছু বিষয়ে দ্বিমতের কথা বিভিন্ন সভা-সেমিনারে আলাদাভাবে বলেছে। বর্তমান সময়ের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি গণপরিষদ নির্বাচনের বিষয়টিতে কোনোভাবেই সম্মতি দেবে না- এ কথা দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বক্তব্যে পরিষ্কার হয়েছে। অন্যদিকে নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গণপরিষদ নির্বাচন ও সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিয়ে কথা বলছে। যেহেতু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফল এই অন্তর্বর্তী সরকার, তাই ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়া দল এনসিপির কথায় বর্তমান সরকার গুরুত্ব দিয়ে আসছে বলে প্রতীয়মান।

এসব কারণে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সাম্প্রতিক সময়ের বক্তব্য এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে দেশি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্য নিয়ে ধোঁয়াশা দেখছেন রাজনৈতিক নেতারা।

বিএনপির শীর্ষনেতাদের অনেকেই বলছেন, নানা অজুহাতে নির্বাচন পেছানোর পাঁয়তারা চলছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, কিছু কিছু লোক নির্বাচন প্রক্রিয়া পিছিয়ে দেওয়ার জন্য, নির্বাচন না করার জন্য একটা অজুহাত তৈরির পাঁয়তারা করছে। এতে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত কাজ করছে। বাংলাদেশ যদি অস্থিতিশীল হয়ে যায়, অনেকেরই ক্ষতি হবে। নির্বাচন যারা পিছিয়ে দিতে চাচ্ছে, তাদের ক্ষতি হবে। নির্বাচন প্রক্রিয়া পেছানোর জন্য কোনো অজুহাত তৈরি করা যাবে না।

একদিকে রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য চাপ দিচ্ছে, অন্যদিকে বিএনপিসহ বেশকিছু দল এখনও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পাঠানো সুপারিশের ভিত্তিতে তাদের মতামত দিতে ব্যর্থ হয়েছে। গত ১৩ মার্চ ছিল রাজনৈতিক দলের মতামত পাঠানোর শেষ দিন। গতকাল পর্যন্ত মোট ১৩টি দল মতামত দিয়েছে। বিএনপি-জামায়াতসহ কয়েকটি দল এখনও মতামত দিতে পারেনি। যেসব দল মতামত দেয়নি তারা আরও কিছু দিন সময় চেয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশের বিষয়ে মতামত পাওয়ার পরই আলোচনা শুরু করবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ফলে সংস্কার কাজে আরও ধীরগতি নেমে এসেছে।

সংস্কার ও নির্বাচন প্রস্তুতি এক সঙ্গে চলতে পারে কিনা জানতে চাইলে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, সংস্কার ও নির্বাচন দুটোই দরকার। এখানে একটা আরেকটার পরিপূরক। দুটো সমান্তরালে চলতে পারে। কিছু সংস্কার রয়েছে যেগুলো বিধি-বিধান পরিবর্তন করে অধ্যাদেশ জারি করেও করা যায়। আর কিছু সংস্কার করতে হলে সংবিধান শোধন করতে হবে, সেটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। তাই সংস্কার ও নির্বাচন দুটোই চলতে পারে- এতে কোনো বাধা নেই।

এদিকে নির্বাচন কমিশন থেকে বারবার বলা হয়েছে, ডিসেম্বরকে লক্ষ্যে রেখেই তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে। গত ১০ মার্চ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন বলেছেন, ‘যেহেতু একটা টাইমলাইন আছে, আর্লি ডিসেম্বর, সেটাকে মাথায় রেখে আমরা প্রস্তুতি নিয়ে যাচ্ছি। ডিসেম্বরে ইলেকশন হলে তো অক্টোবরে শিডিউল ঘোষণা করতে হবে। আমরা যাতে টাইমলাইনটা মিস না করি, সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

সংস্কার ও নির্বাচন প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্রের ওপর নির্ভর করছে কবে নির্বাচন। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার থাকবে- তারা কবে চায়। তবে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি থেমে নেই। সংস্কার আর নির্বাচন দুটোই চলতে পারে। জুলাই সনদ নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বোঝাপড়া যত দ্রুত হবে, নির্বাচনের দিনক্ষণ তত তাড়াতাড়ি জানা যাবে।