ঈদের আগে বেতন-ভাতার চাপে তৈরি পোশাক খাত
আসন্ন ঈদুল ফিতরের আগে পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস নিয়ে নতুন চাপে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন শিল্প মালিকরা। তারা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে নগদ সহায়তার ৭ হাজার কোটি টাকা না পেলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে। অন্যদিকে নানা দাবিতে এখনও বিভিন্ন স্থানে চলছে শ্রমিকদের আন্দোলন; দিন দিন বাড়ছে অসন্তোষ। কিন্তু এ আন্দোলনকে অযৌক্তিক বলে দাবি করছেন মালিকরা। তারা বলছেন, বাইরের ইন্ধনে শ্রমিকরা অযৌক্তিক আন্দোলন করছেন। আন্দোলন দমনে সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপও কামনা করছেন তারা। তাদের মতে, এ ক্ষেত্রে শিল্প বাঁচাতেই জিরো টলারেন্স প্রয়োজন।
এদিকে সমস্যাগ্রস্ত কারখানার তালিকা করছে নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ। ওই তালিকা আগামীকাল রবিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দেওয়া হবে যাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নগদ সহায়তার অর্থ পান। ঈদের আগে মার্চ মাসের ১৫ দিনের বেতন ও বোনাস পরিশোধের চেষ্টায় আছেন মালিকরা। কিন্তু শ্রমিকদের পক্ষ থেকে ২০ রোজার মধ্যে পুরো মাসের বেতন, ২৫ রোজার মধ্যে বোনাস পরিশোধের দাবি তোলা হয়েছে।
নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম আমাদের সময়কে বলেন, ঈদের আগে অস্থিরতা সৃষ্টি করতেই কিছু শ্রমিক আন্দোলন করছেন। এটি অযৌক্তিক। তাদের আন্দোলন যৌক্তিক হলে শ্রমিকদের মধ্য থেকে আরেক গ্রুপ তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াত না। তিনি বলেন, ঈদের আগে বেতন-বোনাস পরিশোধ করার জন্য সরকারের কাছে নগদ সহায়তার ৭ হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। ওই টাকা চেয়ে আমরা আবেদন করেছি। অন্তত ৫ হাজার কোটি টাকা পেলেও মোটামুটিভাবে ঈদ পার করা যাবে।
বাংলাদেশ চেম্বারের সভাপতি আনোয়ার উল-আলম পারভেজ আমাদের সময়কে বলেন, শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন টাকার জন্য। টাকা দিলে তো আর আন্দোলন করবেন না। এ জন্য সর্বপ্রথম টাকার প্রয়োজন। আর ব্যাংকের সহযোগিতা ছাড়া বেতন-বোনাস দেওয়া সম্ভব হবে না। এ সংকটে ব্যাংকগুলোকে পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।
অন্যদিকে শ্রমিক নেতা মোশরেফা মিশু বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করা শ্রমিকরাই এখন বড় বৈষম্যের শিকার। এখনও তারা ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শ্রমিকদের স্পষ্ট দাবি
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
হচ্ছে- ২০ রোজার মধ্যে পুরো মার্চ মাসের বেতন পরিশোধ করতে হবে এবং ২৫ রোজার মধ্যে এক মাসের বেসিক বেতনের সমান বোনাস পরিশোধ করতে হবে। অন্যথায় শ্রমিকরা রাস্তায় নামলে এর দায় মালিকদের নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, দেশে সরকার আছে বলে মনে হয় না। এখনও বেতন-বোনাসের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কথা বলা হচ্ছে না। সব সময় ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। এর পরও মালিকরা নয়ছয় করেন। এ পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বৈঠক হয়নি। শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরকার বসেনি। তাহলে এর দায় কে নেবে, প্রশ্ন রাখেন তিনি।
এদিকে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অধিকাংশ শিল্প-কারখানা দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং উৎপাদন কমে গেছে। অনেক কারখানায় উৎপাদন ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে গেছে। সরকারি প্রকল্পগুলোও স্থবির হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় মালিকরা ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছেন।
তৈরি পোশাকশিল্প কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও কাঁচামাল আমদানি ও জ্বালানি সংকটের কারণে তারা চাপে রয়েছেন। অনেক মালিক সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তা চেয়েছেন যেন বেতন-বোনাস দেওয়া সম্ভব হয়। সরকারের কাছে বিকেএমইএ সাত হাজার কোটি টাকা সহায়তা চেয়েছে। কারণ তাদের নগদ অর্থের সংকট রয়েছে এবং ঈদের সময় শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করতে না পারলে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিতে পারে।
অন্যদিকে পাট ও পাটজাত পণ্য খাতও সংকটে রয়েছে, যেখানে দুই লাখ শ্রমিকের বেতন দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। গ্যাসের সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং স্থানীয় বাজারে অনেক পণ্য বিক্রি হয়নি।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
সম্প্রতি বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমের সই করা এক চিঠিতে বলা হয়, এক কঠিন সময় পার করছে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। তৈরি পোশাকশিল্পে বিরাজ করছে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি। ফলে কার্যাদেশ বাড়লেও বিভিন্ন কারখানায় নগদ অর্থের সংকট দেখা দিয়েছে। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে বেতন-বোনাসসহ অন্যান্য ভাতা পরিশোধ করতে না পারলে আবার শ্রম অসন্তোষ দেখা দেওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় স্বার্থান্বেষী মহল পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তোলার সুযোগ পাবে। তাই নগদ সহায়তা বাবদ সাত হাজার কোটি টাকা ছাড় করা না হলে রপ্তানি খাতে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। চিঠিতে আরও বলা হয়, বিগত সময়েও দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলের কারখানায় শ্রম অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। ফলে কারখানাগুলো বন্ধ থাকায় উৎপাদন কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। তাই এ সময়ে অস্বাভাবিকভাবে উৎপাদন খরচও বেড়ে গেছে। রপ্তানি শিল্পের ওপর কিছু দেশের বায়ারদের আস্থা ধরে রাখতে তৈরি পোশাকশিল্প উদ্যোক্তারা অনেক ক্ষেত্রে মূল উৎপাদন খরচ থেকে কম মূল্যে কার্যাদেশ গ্রহণে বাধ্য হয়েছেন। ফলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে কার্যাদেশ বাড়লেও বিভিন্ন কারখানায় নগদ অর্থের সংকট দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া সামনেই আছে ঈদের বেতন ও বোনাসের বিশাল চাপ। এমন পরিস্থিতিতে বেতন-বোনাসসহ অন্যান্য ভাতা পরিশোধ করতে না পারলে শ্রম অসন্তোষ দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ন্যূনতম পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড় পেলে শ্রমিক-মালিক উভয়ের জন্য স্বস্তির হবে।
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ঈদের আগে শ্রমিকদের মজুরি, বোনাস দিতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। কোনো শ্রমিক তার পাওনা না নিয়ে বাড়ি যাবেন না। এর জন্য সরকারকে আরেকটু সহনীয় হতে হবে। সরকারের কাছে এখনও প্রণোদনার সাত হাজার কোটি টাকা পাওনা। এর মধ্যে সম্প্রতি দুই হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধে আরও অন্তত তিন হাজার কোটি টাকা ছাড় দেওয়ার দাবি জানিয়েছি আমরা।
শিল্প মালিকরা বলছেন, কারখানা চালু রাখতে কর্মীও দরকার। কিন্তু শিল্প-কারখানায় চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না পাওয়ায় উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের আশ্বাস দিয়ে প্রতি ইউনিট ১১ থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। এর পরও গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে না। গ্যাসসংকটে ডিজেল দিয়ে ডায়িং কারখানায় উৎপাদন করা গেলেও স্ট্যান্ডার্ড ও ড্রাক করা যাচ্ছে না। আর ফ্যাব্রিকস ডায়িং করাতে না পেরে সুইং, ফিনিশিং, নিটিং অ্যান্ড প্রিন্টিং সেকশনের শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে হচ্ছে।
বস্ত্র খাতের বড় সংগঠন বিটিএমএ পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, ভারতের আগ্রাসন ও সুতা অ্যান্টিডাম্পিং করার ফলে চলতি বছর রোজার ঈদে স্থানীয় বাজারে প্রায় দেড়শ কোটি ডলারের পণ্য অবিক্রীত থাকবে। ভারত সরকার তাদের উদ্যোক্তাদের সুতা উৎপাদনে ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে ৩০ শতাংশ বেশি সুতা আমদানি করেছেন। এতে দেশীয় সুতা ডাম্পিং হচ্ছে।