ভেঙে পড়ার মুখে ন্যাটো

ট্রাম্প ফর্মুলায় ঘুরে যেতে পারে ইতিহাসের মোড়

আমদের সময় ডেস্ক
০৮ মার্চ ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
ভেঙে পড়ার মুখে ন্যাটো

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন বলেছেন, রুশ আগ্রাসনের কোনো ‘সীমা-পরিসীমা নেই’ এবং ইউরোপের জন্য তা সরাসরি হুমকি। ব্রাসেলসে গত বৃহস্পতিবার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) ২৭টি দেশের নেতাদের জরুরি প্রতিরক্ষা সম্মেলনের আগে গত বুধবার ম্যাক্রন এ কথা বলেন।

ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপের দেশগুলোর এবং ইউরোপীয় সামরিক জোট ন্যাটোর ভবিষ্যৎ-সম্পর্ক যখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, ঠিক সে সময় তার এ বক্তব্য এলো। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘কে বিশ^াস করে আজকের রাশিয়া ইউক্রেনেই থেমে যাবে?’

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কার্যালয় হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে বাগ্বিত-ায় ভেস্তে যাওয়া বৈঠকের পর এই প্রথম একত্র হয়েছেন ইইউ নেতারা। ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অনিশ্চিত হয়ে পড়া সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়াই ইউরোপের ভাগ্য নির্ধারণে নিষ্পত্তিমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন তারা। জেলেনস্কিও এ সম্মেলনে উপস্থিত থাকছেন। খবর : আলজাজিরা, সিএনএন, ড্রাজরিপোর্ট, রয়টার্স।

হোয়াইট হাউসে ওই বৈঠকে জেলেনস্কিকে রাশিয়ার সঙ্গে শান্তির সমঝোতায় আসার জন্য বলেছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু জেলেনস্কি তা অগ্রাহ্য করায় শুরু হয় বাগ্বিত-া, যাতে জড়িয়ে পড়েন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সও। এরপর বৈঠকটি ভেস্তে যায়। ওই ঘটনার পর ইউক্রেনকে যাবতীয় সামরিক সাহায্য প্রদান বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যার মধ্যে গোয়েন্দা সহযোগিতার বিষয়টিও রয়েছে।

এমন পরিস্থিতির মধ্যেও জেলেনস্কির হাত ছাড়তে নারাজ পশ্চিম ইউরোপ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে তিনি সোজা গিয়েছিলেন লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমারের কাছে। আর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে তাকে বিপুল অর্থ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন স্টারমার। এ ছাড়া ইউক্রেনকে সামরিক ও অন্যান্য সহযোগিতাদান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে ফ্রান্স ও জার্মানি। স্টারমার ঘোষণা করেছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ইউক্রেনকে ২৮০ কোটি ডলার ঋণ দেবে ব্রিটেন। তাদের এসব উদ্যোগে স্পষ্ট, আগামী দিনে যুদ্ধের ব্যাপ্তি আরও বাড়বে।

ইতোমধ্যে ট্রাম্প-জেলেনস্কি বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার পর ইইউ-এর নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান কাজা কালাস সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, ‘আজ এটা প্রমাণিত যে ‘মুক্ত বিশ^’ তৈরির জন্য নতুন নেতা প্রয়োজন। এই চ্যলেঞ্জ আমাদের অর্থাৎ ইউরোপীয়দেরই নিতে হবে।’

ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ছাড়াও স্পেন, ডেনমার্ক, পর্তুগাল, ইতালি, সুইডেন, নরওয়েসহ পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ রাষ্ট্র গত তিন বছর রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অন্ধের মতো ইউক্রেনকে মদদ দিয়ে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর এই যুদ্ধ বন্ধের একটা উদ্যোগ নেন, যেটা গত সপ্তাহে ব্যর্থ হয়েছে জেলেনস্কির একগুঁয়েমির কারণে।

ইউক্রেন ইস্যুতে ফাটল দেখা দিয়েছে ন্যাটোতেও। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ফাটল ক্রমশ চওড়া হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইতোমধ্যে ন্যাটো ছাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বলতে গেলে প্রতিরক্ষা খাতে খরচই করে না ন্যাটোর অধিকাংশ ইউরোপীয় রাষ্ট্র। ফলে সমগ্র ইউরোপের নিরাপত্তার ব্যয়ভার একা বইতে হয় যুক্তরাষ্ট্রকে।

যুক্তরাষ্ট্র যদি ন্যাটো থেকে বেরিয়ে যায়, এ আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তাহলে সাবেক সোভিয়েত ও বর্তমান রাশিয়াবিরোধী এই সামরিক জোটটি অনেকাংশে দুর্বল হয়ে যাবে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, তুরস্কও ন্যাটো থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। হাঙ্গেরির মতো রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপারেও আশঙ্কা রয়েছে।

এমন অবস্থায় ইউক্রেনকে মদদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়াই পৃথকভাবে চলতে চাইছে ইইউ। ব্রাসেলসে গতকালের জরুরি সম্মেলন সে জন্যই। এর ফলে কি নতুন করে বিভক্ত হতে চলেছে বৈশি^ক ক্ষমতার কেন্দ্র? ন্যাটো কি হারাতে বসেছে তার সবচেয়ে বড় শরিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে?

ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, ন্যাটোতে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্তি অবাস্তব। ইউরোপ থেকে নিজের সেনা ফিরিয়ে নেওয়ার হুমকিও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই প্রেক্ষাপটে ইইউ নেতারা শান্তির পরিবর্তে ইউক্রেনকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে যে মদদ দিচ্ছেন, জেলেনস্কিকে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ জোগানোর যে সিদ্ধান্ত নিতে ব্রাসেলসে একত্র হয়েছেন, সেটার বিচক্ষণতা প্রশ্নসাপেক্ষ। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রন আরও বলেছেন, ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর সেনাপ্রধানদের সঙ্গে আগামী সপ্তাহে বৈঠক করবেন তিনি। ইউক্রেনে সেনা পাঠানোই হবে বৈঠকের আলোচ্য বিষয়। এমনকি তিনি ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রে ফরাসি পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনও করতে চান।

এদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের দপ্তর ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ সাংবাদিকদের বলেছেন, ম্যাক্রনের বক্তব্য ‘চরম সংঘাতমূলক’ এবং এটা স্পষ্ট যে ফ্রান্স শান্তি চায় না। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভও একই মন্তব্য করে বলেছেন, ম্যাক্রনের মন্তব্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে হুমকি।