খুলনায় বেড়েই চলছে অবৈধ বিদেশি সিগারেটের বাজার

অনলাইন ডেস্ক
০৭ মার্চ ২০২৫, ২৩:৩৯
শেয়ার :
খুলনায় বেড়েই চলছে অবৈধ বিদেশি সিগারেটের বাজার

অবৈধপথে আসা বিদেশি সিগারেটের রমরমা ব্যবসায় ছেয়ে গেছে খুলনা মহানগরীসহ জেলার বিভিন্ন বাজার। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা খারাপ হয়ে যাওয়ায় এ জেলায় আগের তুলনায় বেড়েছে বিদেশি সিগারেটের ব্যবসা। খুলনা ভ্যাট কমিশনারেট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে ২৯ শতাংশ বেড়েছে অবৈধ বিদেশি সিগারেটের জব্দের পরিমান।  

ভ্যাট কমিশনারেটের হিসাব অনুযায়ী, গত ১৪ মাসে কমিশনারেটের আওতাধীন জেলাগুলোর বাজার ও মার্কেটে অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন ব্রান্ডের ২ লাখ ৩৭ হাজার ৪৫৯ শলাকা অবৈধ সিগারেট আটক করা হয়েছে। যার বাজারমূল্য প্রায় ২০ লাখ টাকা। 

এনবিআর এর অভিযান:

সম্প্রতি সরকার অনেক পণ্যের সঙ্গে সিগারেটের ওপর ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর ফলে সিগারেটের দামও বেড়েছে। যার কারণে কম দামি এসব অবৈধ সিগারেটের বাজারও বেড়ে গেছে। এতে করে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে মোটা অঙ্কের রাজস্ব থেকে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দ্বিতীয় সচিব প্রণয় চাকমার সই করা আদেশ সূত্রে জানা যায়, এবার অবৈধ ও রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া সিগারেট নিয়ন্ত্রণে অভিযান পরিচালনা করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও ভ্যাট কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে কমিটি করা হচ্ছে। এ কমিটি চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪১ দিনে মোট ১৫৯টি অভিযান পরিচালন করেছে। 

খুলনায় ভ্যাট কমিশনারেটের অভিযান:

বছরব্যাপী খুলনার কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারাটের আওতাধীন জেলায় অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন ব্রান্ডের ২ লাখ ৩৭ হাজার ৪৫৯ শলাকা অবৈধ সিগারেট আটক করা হয়েছে। যার বাজারমূল্য ১৯ লাখ ৯২ হাজার ৯২৯ টাকা। 

এর মধ্যে খুলনা জেলায় ১৭টি অভিযানে ৪১ হাজার ৮০০, বাগেরহাটে ১টি অভিযানে ১ হাজার ৯২০, বড়গুনায় ১টি অভিযানে ৪ হাজার ৯২০, ঝালকাঠিতে ১টি অভিযানে ৩ হাজার ১১৬টি, পটুয়াখালিতে ১২টি অভিযানে ৫৭ হাজার ৮০টি, মাদারিপুরে ৫টি অভিযানে ১ হাজার, শরিয়তপুরে ১টি অভিযানে ১৩ হাজার ৮৯৫টি, ভোলায় ৩টি অভিযানে ১ হাজার ৫২৬টি, বরিশালে ১টি অভিযানে ১৯ হাজার ৯১৮ এবং ৩টি অভিযানে ১৩ হাজার ১৭৯টি অবৈধ সিগারেট আটক করা হয়েছে। 

বিনা বাধায় বিক্রি হচ্ছে বিদেশি সিগারেট: 

খুলনার একাধিক খুচরা সিগারেট বিক্রয় করা দোকান ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি দোকানে কমবেশি বিদেশি সিগারেট রয়েছে। বিক্রেতারা এই সিগারেটকে বিলাসি সিগারেট আখ্যা দিয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, একটা শ্রেণির মানুষ অনেকটা বিলাসিতা করে এ সিগারেট কিনছেন। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে তাদের কাছে এই সিগারেট পৌঁছে দেয় একটি চক্র। রাজস্ব দিতে হয় না বলে কিছুটা কম দামে খুচরা বিক্রেতারা এই সিগারেট কিনতে পারেন। তবে প্রতি প্যাকেটে ভালোই লাভ থাকে বিধায় তারাও বিক্রি করতে আগ্রহী। তবে কারা এই সিগারেট পৌঁছে দেয়, কোথায় মজুত থাকে এসব বিষয়ে খুচরা বিক্রেতারা মুখ খুলছে নারাজ।

খুলনার সাত রাস্তার মোড় এলাকার খুচরা ব্যবসায়ী জুলফিকার জানান, খুব সহজেই তারা এসব বিদেশি সিগারেট সংগ্রহ করতে পারেন। এ জন্য কোথাও যেতে হয় না। সাইকেলে করে বিক্রয় কর্মীরা এসে সিগারেট দিয়ে যায়। আবার ফোন করলেও সিগারেট পৌঁছে দেয়। বিদেশি সিগারেট বিক্রি করলে তাদের লাভ অনেক বেশি থাকে। তাই দিন দিন এসব সিগারেটের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বিক্রয় প্রতিনিধিরা কোথা থেকে এসব সিগারেট সংগ্রহ করে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন ধারণা নেই তার।

খুলনার খুচরা ব্যবসায়ী আমিনুল বলেন, লাগেজ পার্টির মাধ্যমেই মূলত অবৈধভাবে এসব সিগারেট দেশে আসছে। তবে বিদেশি সিগারেট বিক্রি করা যে অবৈধ তা স্বীকার করেন তিনি। এসব সিগারেট বিক্রি করতে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয় কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, আগে খুব বেশি বিক্রি হতো, কিন্তু মাঝে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে এসব সিগারেট লুকিয়ে বিক্রি করতেন। তবে গত কয়েক বছর ধরে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। বর্তমানে প্রকাশ্যেই প্রর্দশন করে বিক্রি করতে পারছেন। 

খুলনার কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারাটের একজন ঊর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, ‘সারাদেশের মতো খুলনা অফিস অবৈধ বিদেশি সিগারেট জব্দে অভিযান পরিচালনা শুরু করেছে। এছাড়াও অবৈধ সিগারেট বিক্রয় বন্ধে মাইকিংসহ বিভিন্ন প্রচারণা চালানো হচ্ছে। অবৈধ সিগাটের জব্দে খুলনা ভ্যাট অফিস কঠোর অবস্থানে রয়েছে। ’ 

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযান:

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর খুলনা বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, খুলনায় গত ৭ মাসে মোট ১ হাজার ৮২টি বাজার/প্রাতিষ্ঠানিক অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। উক্ত অভিযান সমুহে মোট ১ হাজার ৯৫৫টি প্রতিষ্ঠানকে সর্বমোট ১ কোটি ৪৪ লাখ ৫০টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। পরিচালিত অভিযানের মধ্যে শিল্প কলকারখানা, বিভিন্ন রকম দোকানপাট, অবৈধ ও নকল দেশি-বিদেশি সিগারেট উল্লেখযোগ্য। 

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ সেলিম রেজা জানান, আমাদের অভিযানা চলমান রয়েছে। এরমধ্যে যারা অবৈধভাবে সিগারেটসহ অন্যান্য মালামাল বিক্রি করছে এবং সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রবাদির বাজার সমূহ দোকানপাট খুব বেশি মনিটরিং করা হবে। 

বিদেশি সিগারেটে সয়লাব মহানগরী ও প্রত্যান্ত অঞ্চল: 

অবৈধ ও বিদেশি সিগারেটে সয়লাব হয়ে গেছে খুলনার মহানগরীসহ জেলার বিভিন্ন প্রত্যান্ত অঞ্চলের বাজার। আর উঠতি বয়সের তরুণ সমাজ, শিক্ষার্থী ও যুবক-যুবতীরা বিদেশি এসব সিগারেটের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। খুলনা মহনগরীর বিভিন্ন এলাকায় সরজমিন পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, মহানগরীর বিভিন্ন দোকানে বিদেশি বিভিন্ন সিগারেট দেদারছে বিক্রি করা হচ্ছে। বিশেষ করে বিভিন্ন ফ্লেবার ও আকর্ষণীয় মোড়কে মোড়ানো বিভিন্ন নামের বিদেশি সিগারেটে খুলনা মহানগরীর সিগারেট দোকানগুলো সয়লাব হয়ে গেছে। বিশেষ করে মহানগরীর রূপসা, টুটপাড়া, পিটিআই, রয়্যাল মোড়, সাতরাস্তা, ময়লাপোতা, শিববাড়ী, ফেরিঘাট, রেলস্টেশন, সাত নম্বর ঘাট, নিউমার্কেট, সোনাডাঙ্গা, গল্লামারী, জিরো পয়েন্ট, নিরালা, শান্তিধাম, খালিশপুর, দৌলতপুর, বয়রা ও বিএল কলেজ মোড় এলাকার বিভিন্ন স্থানে এসব বিদেশি তামাকপণ্য বিক্রি হচ্ছে। অবৈধ বিদেশি সিগারেগুলোর মধ্যে রয়েছে-পাট্রন, মন্ড, অরিচ, ইজি, মালব্রো, ডানহিলম ৫৫৫, ৯৯৯, ৩০৩, ব্লাক, এক্সসো, গুডাং গ্রাম, বরকুম চেরি, মেভিস, বিএসএস, সিগার, বেনসন, চেনজাং, উলসন ল্যান্ড এম, ত্রি জিরো ত্রি, মডার্ন, ডাবল হ্যাপিনেস। শুধু খুলনা মহানগরী নয়, জেলার আশেপাশের উপজেলার পৌর শহরে এসব অবৈধ বিদেশি সিগারেটের রমরমা বাণিজ্য চলছে।

বিদেশি সিগারেট কিনতে আসা রিফাত নামের এক তরুণ জানান, বিদেশি সিগারেট বিভিন্ন ফ্লেবারের হয়। তাই এই সিগারেটগুলো কিনেন তারা। এছাড়াও বিদেশি সিগারেটের দাম কম ও সম্প্রতি আবারও সিগারেটের দাম বেড়ে যাওয়ায় তারা এই সিগারেটগুলোর দিকে বেশি ঝুঁকছেন। 

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার (মিডিয়া ও সিপি) মো. আহসান হাবিব বলেন, ‘শুনেছি সম্প্রতি এনবিআর খুলনার বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ সিগারেট জব্দে অভিযান পরিচালনা করছে। তারা অভিযান পরিচালনার সময় আমাদের কোনো ধরনের সাহায্যের প্রয়োজন হলে আমরা তাদের সহযোগীতা করবো। ’ 

রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসা এসব অবৈধ বিদেশি সিগারেট চোরাচালান বন্ধ না হওয়ায় প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। তাই দ্রুত অবৈধ সিগারেট চোরাচালান বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।