উন্নয়ন বাজেটে কাটছাঁট ৪৯ হাজার কোটি টাকা

আব্দুল্লাহ কাফি
০৩ মার্চ ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
উন্নয়ন বাজেটে কাটছাঁট ৪৯ হাজার কোটি টাকা

আর্থিক সংকট, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, অনিয়ম-দুর্নীতির লাগাম টানার পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয়, কম গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় নিয়ে চলতি বছরের উন্নয়ন বাজেট থেকে ব্যাপক পরিমাণ বরাদ্দ কাটছাঁটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে কাটছাঁটের এই অর্থের পরিমাণ হবে ৪৯ হাজার কোটি টাকা। যা এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। আজ সোমবার শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত আসতে পারে। বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও এনইসি চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।

সূত্র বলছে, ব্যাপক এই অর্থ কাটছাঁটের মূল কারণ হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন, উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থছাড় না করা, অন্তর্বর্তী সরকারের কড়াকড়ি, অদক্ষতায় সময়মতো কাজ করতে না পারা এবং পুরনো সমস্যার আবর্তে ঘুরপাক।

পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সম্প্রতি জানান, আমরা চাচ্ছি এ অর্থবছরে এডিপি ছোট থাকুক। অনেক বড় বরাদ্দ দিয়ে ব্যয় করতে না পারলে সেটি ভালো দেখায় না। সেই সঙ্গে এবার বাজেট ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন আসছে। আগে থেকেই রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় ঘাটতি বেশি রেখে বরাদ্দ দেওয়া হবে না। কেননা বেশি ঘাটতি হলে মূল্যস্ফীতি হতে পারে। আগামী সপ্তাহে সংশোধিত এডিপি নিয়ে বৈঠক করব। সেখানে খসড়া চূড়ান্ত করা হবে। তবে এবার বড় অঙ্কের বরাদ্দ কমবে।

এদিকে চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) এডিপি বাস্তবায়নেও বিরাজ করছে করুণদশা। ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও গত ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বরাদ্দের এক শতাংশ অর্থও খরচ করতে পারেনি। এগুলো হলো স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া ১৯টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের এডিপি বাস্তবায়ন হার এখনও ১০ শতাংশের নিচেই রয়েছে। সার্বিকভাবে এডিপির বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ হার ছিল ২২ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৩ দশমিক ৫৩, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ০৬ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ে বাস্তবায়ন হয়েছিল ২৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্র বলছে, চলতি অর্থবছরের এডিপিতে মোট বরাদ্দ রয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা (স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দ ছাড়া)। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের এক লাখ ৬৫ হাজার কোটি এবং বৈদেশিক ঋণ থেকে ১ লাখ কোটি টাকা। কিন্তু সংশোধিত এডিপিতে মোট বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। ফলে বরাদ্দ কাটছাঁট হচ্ছে ৪৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের বরাদ্দ দেওয়া হবে ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি এবং বৈদেশিক ঋণ থেকে ৮১ হাজার কোটি টাকা।

পরিকল্পনা কমিশন থেকে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বলা হয়েছে, যে টাকা খরচ করা সম্ভব, শুধু সেই পরিমাণ অর্থই বরাদ্দের জন্য চাহিদা দিতে হবে। প্রয়োজনে পরে আরও বরাদ্দ সমন্বয় করা যাবে। কিন্তু কোনোভাবেই বাড়তি টাকা নেওয়া যাবে না। এ ছাড়া অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে ৭টি বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়। এগুলো হলো চলতি অর্থবছরে সমাপ্ত হবে, এমন প্রকল্পে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে হবে। যদি কোনো প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়া বা কমার প্রয়োজন হয়, তাহলে অবশ্যই এডিপির খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার আগেই করতে হবে। বৈদেশিক অর্থায়নপুষ্ট প্রকল্পের ম্যাচিং ফান্ড হিসেবে সরকারি অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে। মূলধন, রাজস্ব, সিডি ভ্যাটসহ অন্যান্য নগদ বৈদেশিক মুদ্রা অন্যান্য খাতে সর্বশেষ অনুমোদিত প্রকল্প দলিল অনুযায়ী সঠিকভাবে বরাদ্দ রাখতে হবে। ইতোমধ্যে যে পরিমাণ অর্থ অবমুক্ত করা হয়েছে প্রকল্পের অনুকূলে, সে পরিমাণ অর্থ রাখতে হবে। ইআরডি থেকে দেওয়া বৈদেশিক ঋণ বা অনুদানের বরাদ্দ পরিবর্তন করা যাবে না। এ ছাড়া প্রকল্পের সংশোধন বা মেয়াদ বৃদ্ধি হলে এএমএস সফটওয়্যারে হালনাগাদ তথ্য দিতে হবে।

বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) জানায়, গত অর্থবছর এডিপিতে মোট বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৭৪ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে এসে ২০ হাজার ২৮২ কোটি টাকা কাটছাঁট করে মোট বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয় ২ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। এ অর্থবছর শেষে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো খরচ করতে পেরেছিল ২ লাখ ৫ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ বরাদ্দ কমিয়ে যা দেওয়া হয়েছিল তার ৮০ দশমিক ৯২ শতাংশ।

২০২২-২৩ অর্থবছরে মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৫৬ হাজার ৩ কোটি টাকা। অর্থবছরের মাঝপথে এসে ১৯ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা বাদ দিয়ে বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয় ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত খরচ হয়েছিল এরও কম, ২ লাখ ১ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ বরাদ্দের ৮৫ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে মূল বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৩৬ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এরপর ১৭ হাজার ১৯০ কোটি টাকা বাদ দিয়ে সংশোধিত বরাদ্দ দেওয়া হয় ২ লাখ ১০ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত খরচ হয়েছিল ২ লাখ ৩ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা বা ৯২ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এ ছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে মূল এডিপি বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ১৪ হাজার ৬১১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা কাটছাঁট করে সংশোধিত বরাদ্দ দেওয়া হয় ২ লাখ ৯ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খরচ হয়েছিল ১ লাখ ৭১ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের ৮২ দশমিক ১১ শতাংশ।