রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্রিড নির্মাণে ডলার সংকট

লুৎফর রহমান কাকন
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্রিড নির্মাণে ডলার সংকট

নানা জটিলতায় রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনে আসা পিছিয়ে গেছে। এখন নতুন করে ডলার সংকট জেঁকে বসেছে। ডলার সংকটের কারণে বা পাওনাদারদের বিল পরিশোধ করতে না পারায় গ্রিড লাইন নির্মাণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি মাসের শুরুতেই পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) থেকে একটি স্কিমের বিল পরিশোধ করতে ২৬ মিলিয়ন ডলার চাওয়া হলেও ডলার মিলছে না। পরবর্তী সময়ে পিজিসিবি থেকে প্রতি সপ্তাহে অন্তত ৫ মিলিয়ন ডলার করে পরিশোধের অনুরোধ করলেও তা একসঙ্গে মিলছে না। দুই থেকে তিনবারে দেওয়া হয়েছে ৫ মিলিয়ন ডলার।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, রূপপুর প্রকল্পের যমুনা ও পদ্মা নদীতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ ইভাকুয়েশনের জন্য ৪০০ কেভি ও ২৩০ কেভি রিভার ক্রসিং সঞ্চালন লাইন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলছে। তবে পিজিসিবি পাওনাদারদের বিল পরিশোধ করতে না পারায় কাজে স্থবিরতার আশঙ্কা রয়েছে। যদিও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কাজ এখনও চলছে।

মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ সঞ্চালন স্কিমটি ৭৫ শতাংশ সরকারের এবং ২৫ শতাংশ পিজিসিবির অর্থায়নে। প্রকল্পটির ঠিকাদারকে কাজের বিল ৪৫ দিনের মধ্যে দেওয়ার কথা থাকলেও ডলার সংকটে তা পরিশোধ করতে ৪ মাস পার হয়ে যাচ্ছে।

পিজিসিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, স্কিমটির এলসি ব্যাংকগুলো থেকে ডলার পরিশোধে বাংলাদেশ ব্যাংককে বারবার অনুরোধ করলেও কাজ হচ্ছে না। এমনকি ডলার ছাড়ের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিবও নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে, তবু প্রয়োজনীয় ডলার মিলছে না।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, চলতি অর্থবছরে ৯ জানুয়ারি অর্থ ছাড় করা হয়েছে। এরপর মাঠপর্যায়ে নির্মাণ কাজের লক্ষ্যে ঠিকাদারের বিল এবং মালামাল সরবরাহের জন্য ইনভয়েস অনুমোদন করা হয়েছে। পেমেন্ট সার্টিফিকেট ইস্যু করা হলেও সোনালী ব্যাংক এলসি খুলতে পারছে না ডলার সংকটে। এক স্কিমেই এ পর্যন্ত ২৬ মিলিয়ন ডলার বকেয়া পড়েছে।

তিনি আরও জানান, এর মধ্যে আমদানিকৃত স্টিল টিউব, স্টিল কেসিং, সঞ্চালন লাইনের স্পেয়ার পার্টস বাবদ বকেয়া পড়েছে ১১.৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং মাঠপর্যায়ের কাজের জন্য আরও ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ বকেয়া পরিশোধ করতে বারবার তাগাদা দিয়েও মিলছে না। সর্বশেষ তিন কিস্তিতে মিলেছে ৫ মিলিয়ন ডলার।

পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুর রশিদ খান আমাদের সময়কে বলেন, আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে সামগ্রিক বিষয় অবহিত করেছি।

গ্রিড নির্মাণে দেরি হওয়ার কারণে রূপপুর প্রকল্প সময়মতো উৎপাদনে আসতে পারছে না- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, বিষয়টি ঠিক নয়। আমাদের দুটি গ্রিড লাইন পুরোপুরি প্রস্তুত। কর্তৃপক্ষ চাইলে এখনই এক ইউনিটের ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গ্রিডে সরবরাহ করা সম্ভব। তবে মূল প্রকল্পেই এখনও সাবস্টেশন নির্মাণসহ কিছু কাজ বাকি আছে।

২৪শ মেগাওয়াট সক্ষমতার নির্মাণাধীন দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে প্রথম ইউনিটটি ২০২৪ সালে উৎপাদনে আসার কথা থাকলেও ২০২৫ সালের শেষের দিকে বা ২০২৬ সালের প্রথম দিকে আসতে পারবে কিনা, সেটা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। যদিও ২০২৩ সালেই প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে আসার পরিকল্পনা ছিল। রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সঞ্চালন ও সরবরাহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে গ্রিড ও সঞ্চালন ব্যবস্থার উন্নয়ন।

২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রস্তুতিমূলক পর্যায়ে নির্মাণকাজ সম্পাদনের জন্য ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের রাষ্ট্রীয় রপ্তানি ঋণ সংক্রান্ত একটি চুক্তি সই হয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ২০১৫ সালে মস্কোর সঙ্গে ১২.৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সাধারণ চুক্তি সই করে সরকার। বাংলাদেশ ২০১৬ সালের জুলাই মাসে আরএনপিপির জন্য ১১.৩৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে রাশিয়ার সঙ্গে আর্থিক চুক্তি সই করে। এই অর্থ মোট ব্যয়ের ৯০ শতাংশ।

এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ইভাকুয়েশনের জন্য সঞ্চালন অবকাঠামো উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের জন্য ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল একনেক সভায় দশ হাজার ৯৮১ কোটি ৭৪ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদন হয়। ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। পরবর্তীকালে এ প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি না করে মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০১৮ সলের ১ এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। যমুনা ও পদ্মা নদীতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ ইভাকুয়েশন সংশ্লিষ্ট ৪০০ কেভি ও ২৩০ কেভি রিভার ক্রসিং সঞ্চালন লাইন নির্মাণ শীর্ষক একক স্কিমটি ৬ হাজার ৫৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা যা মোট গ্রিড নির্মাণ সংক্রান্ত প্রকল্প ব্যয়ের ৭৫ শতাংশ সরকারের নিজস্ব ঋণ হিসাবে চার হাজার ৫৪২ কোটি ২৩ লাখ টাকা এবং ২৫ শতাংশ এক হাজার ৫১৪ কোটি ৭ লাখ টাকা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি) নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটির মেয়াদ ১ জুলাই ২০২২ থেকে ৩০ জুন ২০২৫ সাল পর্যন্ত ৩ বছর মেয়াদে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অর্থ বিভাগ ২০২২ সালের ৭ জুলাই অনুমোদন দেয়। তবে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে কিনা নিশ্চিত নন সংশ্লিষ্টরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, মূল প্রকল্প নির্মাণ কাজ সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যাচ্ছিল। তবে স্বাভাবিক অগ্রগতিতে ভাটা পড়ে গ্রিড লাইন নির্মাণ কাজ ধীরগতিতে হওয়ায়। এ ছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কোম্পানি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়াও একটি কারণ।

তিনি বলেন, রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পের গ্রিড লাইন প্রকল্পগুলো ভারতীয় ঋণে হওয়ার কথা ছিল। সেগুলো শুরুর দিকে বেশ জটিলতায় পড়ে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ঋণ ছাড় করতে বেশ সময় নেয়। বাংলাদেশ থেকে বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও দ্রুত ঋণ ছাড় হচ্ছিল না। পরে বাংলাদেশ সরকার গ্রিড লাইন নির্মাণ প্রকল্পে ভারতীয় ঋণ থেকে বেরিয়ে আসে। ততদিনে অনেক সময় চলে যায়।

পিজিসিবি সূত্রে জানা যায়, রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ ইভাকুয়েশনের জন্য ৩টি সঞ্চালন লাইনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে প্যাকেজ-১ বা লট-১ প্রকল্পে রয়েছে রূপপুর-বাঘাবাড়ি ২৩০ কেভি ডাবল সার্কিট লাইন নির্মাণ কাজ। ২০২২ সালের ২৯ জুন রূপপুর-বাঘাবাড়ি সার্কিন লাইনটি কমিশনিং করা হয়েছে। এখন এ প্রকল্পে ব্যাক ফিড পাওয়ার সরবরাহের কাজ চলছে। এছাড়া প্যাকেজ ৫-এর আওতায় রূপপুর-বগুড়া ৪০০ কেভি সিঙ্গেল সার্কিট সঞ্চালন লাইন নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে গত বছর ৩০ এপ্রিল কমিশনিং করা হয়েছে। প্যাকেজ-৩ এর আওতায় রূপপুর-গোপালগঞ্জ ৪০০ কেভি সিঙ্গেল সার্কিট সঞ্চালন লাইনের রুট পবির্তনের কারণে প্রায় সাড়ে ৬ কিলোমিটার লাইন বৃদ্ধির প্রয়োজন পড়ে। ফলে আরও ১৫টি টাওয়ার স্থাপন করতে হবে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে। এদিকে রূপপুর-গোপালগঞ্জ ৪০০ কেভি লাইন নির্মাণের সমন্বয় করে ৪০০ কেভি পদ্মা রিভার ক্রসিং সঞ্চালন লাইনের কাজটি চলতি বছর মার্চের মধ্যে সম্পন্ন হবে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছর জুলাই-আগস্ট মাসে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে প্রকল্পে কর্মরত বিদেশিরা নিজের দেশে ফিরে যায়, ফলে পদ্মা রিভার ক্রসিং সঞ্চালন লাইনের নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তবে এখন আবার কাজ চলছে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট পিজিসিবির এক কর্মকর্তা বলেন, গ্রিড লাইন নির্মাণে কোনো কোনো প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক দফা বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে। এদিকে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু না হলেও রাশিয়ান ঋণের কিস্তি দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।