অনলাইন আয়কর রিটার্নে রেকর্ড সাফল্য, দেশীয় প্রযুক্তির জয়যাত্রা
দেশের অনলাইন আয়কর রিটার্নে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের করদাতারা অনলাইন আয়কর রিটার্ন ব্যবস্থায় রেকর্ড সাড়া দেন। দেশীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সিনেসিস আইটির এই ই-রিটার্ন সিস্টেম চালুর পর অনলাইনে রিটার্ন জমার হার আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩০০ শতাংশ বেড়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির দক্ষতায় সরকারের ডিজিটাল কর ব্যবস্থায় ব্যবহারবান্ধব সফটওয়্যার তৈরির কারণে ১৪ লাখ ৪৩ হাজারেরও বেশি করদাতা অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করেছেন। যা বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ৫ লাখ ২৬ হাজারের মতো।
এছাড়া নতুন অর্থবছরে ই-রিটার্ন সিস্টেমে রেজিস্ট্রেশন করেছেন ১৮ লাখ ৬২ হাজারের বেশি করদাতা। আর এই অর্জনকে দেশের কর ব্যবস্থা ডিজিটালাইজেশনের সফলতা ও ট্যাক্স গভর্ন্যান্সের নতুন দিগন্ত বলে মনে করছে এনবিআর।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, এবারের ই-রিটার্ন জমা দেয়ায় নতুন ধারা সৃষ্টি হয়েছে, এটা আমরা ধরে রাখতে চাই। যারা ফাইল সাবমিশন করেছেন, আমরা তাদের অভিজ্ঞতা শুনবো খুব শীঘ্রই, একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে তাদের নিয়ে। সাধারন মানুষকে ট্যাক্স নিজেই জমা দিতে উৎসাহিত করছি আমরা, আগামী অর্থবছরে এর পরিধি বাড়বে।
আমরা দেশীয় সফটওয়্যারের উপরে ভরসা রাখতে চাই উল্লেখ করে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ই-রিটার্ন সেবায় দেশী সফটওয়্যারের সক্ষমতা আবারো প্রমাণিত হলো। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে।
দেশীয় প্রযুক্তির জয়যাত্রা
দেশীয় প্রতিষ্ঠান সিনেসিস আইটির তৈরি ই-রিটার্ন সিস্টেম করদাতাদের জন্য সহজ, নির্ভুল এবং দ্রুত আয়কর জমার এই সুযোগ তৈরি করেছে। অতীতে ২০১৬ সালে ৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে ভিয়েতনামের কোম্পানি এফপিটির সফটওয়্যার বাইট্যাক্সের (BTAX) মাধ্যমে এনবিআর একটি অনলাইন রিটার্ন সিস্টেম চালু করেছিল, কিন্তু এটি ব্যবহারবান্ধব না হওয়ায় ৬-৭ হাজারের বেশি রিটার্ন জমা হয়নি এবং শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি ব্যর্থ হয়। লক্ষ্য বাস্তবায়ন না হওয়ায় এনবিআর ২০১৯ সালে এই সিস্টেমটি বন্ধ করে দেয়।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
এরপর ২০২০ সালের করোনা মহামারী শুরু হলে অনলাইনে রিটার্ণ জমা নিতে এনবিআরের উপর চাপ তৈরি হয়। করোনা মহামারির সময় আয়কর বিভাগের কর্মকর্তাদের সহায়তায় সিনেসিস আইটি মাত্র চার মাসে ই-রিটার্নের প্রথম ভার্সন সফলভাবে তৈরি করতে সক্ষম হয়।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে ই-টিআইনের মাধ্যমে আয়কর বিভাগ প্রথম অটোমেশন কার্যক্রম শুরু করে, যার শুরু সিনেসিস আইটির হাত ধরে। বর্তমানে ইটিআইন সিস্টেম ১ কোটি ১৭ লাখের বেশী নিবন্ধন হয়েছে যা দেশের একটি অন্যতম বড় ডেটাবেইজ।
কোম্পানিটির প্রধান সলিউশন অফিসার আমিনুল বারী শুভ্র বলেন, ‘সরকার ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের যৌথ প্রচেষ্টার সফল উদাহরণ হলো ই-রিটার্ন। কর ব্যবস্থার ডিজিটাল রূপান্তরে এটি একটি বড় মাইলফলক। ই-রিটার্ণ সিস্টেমের ডিজাইনে সাইবার নিরাপত্তা এবং করদাতার ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি আমরা সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে বিদেশি কোম্পানিগুলোর তৈরি সিস্টেমগুলোর সফলতার হার খুবই কম। অথচ বিপুল অর্থ ব্যয় করে বিদেশি কোম্পানির প্রতি এক ধরনের ঝোঁক আমরা গত সরকারের সময় দেখেছি। এই মনোভাব থেকে বের হয়ে এনবিআর আমাদের প্রতি যে বিশ্বাস রেখেছে, আমাদের দেশীয় উদ্যোক্তাদের পক্ষ হতে কৃতজ্ঞতা।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) সাবেক সভাপতি, বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণে গঠিত টাস্কফোর্সের সদস্য ফাহিম মাশরুর বিশ্বাস করেন দেশীয় সফটওয়্যার কোম্পানি গুলো এখন আন্তর্জাতিক মানের সলিউশন ডেভেলপ করছে, সেক্ষেত্রে বিদেশী সেবাক্রয়ে ডলার খরচ করার কোন মানে নেই।
তিনি বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য সুযোগ তৈরি হয়েছে। সফটওয়ারে বিদেশ নির্ভরতা অনেকটা নির্ভর করে প্রকিউরমেন্ট অথরিটির কর্মকর্তাদের মানসিকতার উপর। আমি মনে করি, ডেটা প্রাইভেসি ও আর্থিক সাশ্রয়ের কথা বিবেচনায় দেশীয় সফটওয়্যারের ব্যবহার বাড়ানো দরকার।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ইতোমধ্যে ইউরোপ, আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের এই ই-রিটার্ন সিস্টেম গ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং একটি দেশের সাথে চুক্তির আলোচনা চলছে।
এনবিআরের এক কর্মকর্তা জানান, ‘এই সিস্টেমটি ভবিষ্যতে কর আদায়ের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠবে। তবে নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মে নিয়মিত হালনাগাদ ও উন্নয়ন ছাড়া প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলানো সম্ভব নয়। নিয়মিত হালনাগাদের মাধ্যমে সফটওয়ারের কার্যকারিতা ও ব্যবহার উপযোগিতা বৃদ্ধি পায়।
তারা মনে করেন, এই সিস্টেমটি ভবিষ্যতে কর আদায় প্রক্রিয়ায় প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠবে। ফলে বর্তমান সাফল্যকে এগিয়ে নিতে হলে সিস্টেমটি নিয়ে আরও কাজ করার সুযোগ আছে।
এদিকে, করদাতাদের জন্য আরও সুবিধা নিশ্চিত করতে মোবাইল ব্যাংকিং, ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড পেমেন্ট এবং কল সেন্টার চালু করা হয়েছে। আয়কর দিবসের পরেও অনলাইন রিটার্ন সেবাটি বছরব্যাপী চালু রাখার পরিকল্পনা রয়েছে এনবিআরের।
এবারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশ্যে অনলাইনে আয়কর জমা দেয়ার আহবান জানালে জনসাধারণের কাছে ব্যাপক আগ্রহ তৈরী হয়। এই বছর অন্তবর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকেও অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রতি বিশেষভাবে জোর দেয়া হয় এবং ২০২৪-২৫ করবর্ষে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কয়েকটি নির্দিষ্ট খাতের পেশাজীবীদের জন্য অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে অবস্থিত সকল সরকারি কর্মচারী, তফসিলি ব্যাংকের কর্মকর্তা, মোবাইল অপারেটর প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এবং বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানির কর্মীদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়।
এ ব্যাপারে করদাতাদের উৎসাহিত করতে গত ২৮ অক্টোবর এক ভিডিও বার্তায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, পর্যায়ক্রমে সকল প্রকার কর অনলাইনে সংগ্রহ করার জন্য আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।
সবার জন্য এখন থেকে আয়কর দেওয়ার পথ মসৃণ ও ঝঞ্ঝাট মুক্ত করার কথা বলেন তিনি।