২৯৯ শিশুর ওপর যৌন নির্যাতন, ফরাসি সার্জনের বিচার শুরু

ফ্রান্স প্রতিনিধি
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:৫২
শেয়ার :
 ২৯৯ শিশুর ওপর যৌন নির্যাতন, ফরাসি সার্জনের বিচার শুরু

ফ্রান্সের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শিশু যৌন নির্যাতনের মামলার বিচারকাজ শুরু হয়েছে। ৭৪ বছর বয়সী প্রাক্তন সার্জন জোয়েল ল্য স্কুয়ার্নেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি বিভিন্ন হাসপাতালে শিশু রোগীদের ওপর যৌন নির্যাতন চালিয়ে গেছেন।

আজ তার বিরুদ্ধে করা ওই অভিযোগের ভিত্তিতেই বিচার শুরু হয়েছে।

প্রাক্তন সার্জন জোয়েল ল্য স্কুয়ার্নেকের বিরুদ্ধে ২৯৯ জনকে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে, যাদের অধিকাংশই শিশু রোগী ছিল। 

২০১৭ সালে ছয় বছর বয়সি প্রতিবেশীকে ধর্ষণের ঘটনার পর সার্জন জোয়েল ল্য স্কুয়ার্নেকের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে প্রচুর পরিমাণে যৌন পুতুল, পরচুলা এবং শিশু পর্নোগ্রাফি খুঁজে পায় পশ্চিম ফ্রান্সের পুলিশ।

তদন্তকারীরা জানান, ১৯৮৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে জোয়েল ল্য স্কুয়ার্নেক তার রোগীদের, বিশেষত অজ্ঞান থাকা শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন চালাতেন। তার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে পাওয়া একটি গোপন ডায়েরিতে ৩১২ জন নির্যাতিত ব্যক্তির নাম পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২৯৯ জনের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ থাকায় মামলাটি আদালতে গড়িয়েছে।

ভুক্তভোগীদের মধ্যে বেশিরভাগই ৬ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশু ছিল, যারা চিকিৎসার জন্য তার কাছে গিয়েছিল। তবে, এর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক নারীরাও তার যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে।

মূলত ২০১৭ সালে এক নাবালিকা শিশুর অভিভাবক পুলিশের কাছে অভিযোগ করলে তদন্ত শুরু হয়। এরপর ২০২০ সালে চার শিশুকে ধর্ষণের অপরাধে তাকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে তার ডায়েরিতে লেখা ভয়ংকর অপরাধের বিবরণ প্রকাশ্যে আসার পর নতুন করে এই মামলাটি গঠন করা হয়।

জানা গেছে, চার মাসব্যাপী এই বিচারপ্রক্রিয়ায় ১৫৮ জন পুরুষ ও ১৪১ জন নারী ভুক্তভোগী আদালতে সাক্ষ্য দেবেন। অভিযুক্ত দোষী প্রমাণিত হলে তাকে সর্বোচ্চ ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হতে পারে।

মামলার বাদি ফ্রাঁসোয়া ১২ বছর বয়সে জোয়েল ল্য স্কুয়ার্নেক দ্বারা নির্যাতিত হওয়ার অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি বুঝতে পারি যে, এই সার্জনের কাছে আমার অস্ত্রোপচার করানো উচিত হয়নি। আমি কর্তৃপক্ষের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছি বলে অনুভব করছি। কেন কেউ এই সার্জনকে শিশুদের সঙ্গে কাজ করতে নিষেধ করেনি?’

এদিকে ২০১৭ সালে জোয়েল ল্য স্কুয়ার্নেকের ডায়েরি আবিষ্কারের পর তদন্তকারীরা হাসপাতালের রেকর্ডের সঙ্গে ডায়েরির বর্ণনা মিলিয়ে সম্ভাব্য ভুক্তভোগীদের খুঁজে বের করতে শুরু করেন। অনেক রোগীকে অ্যানেস্থেসিয়া দেয়া হয়েছিল বলে সবকিছু তাদের মনে নেই। তবে আদালতের নথি অনুসারে মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা ভুক্তভোগীদের মধ্যে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেসের লক্ষণগুলো নথিভুক্ত করেছেন।

২০০৭ সালে ম্যাথিস ভিনেটের বয়স ছিল ১০ বছর। পেটে ব্যথা থাকায় কিম্পেরলে হাসপাতালে তাকে নিয়ে যান তার বাবা এবং দাদা। ৭৮ বছর বয়সি দাদা রোল্যান্ড ভিনেটেরে মনে আছে যে, তিনি জোয়েল ল্য স্কুয়ার্নেকের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘রাতে ম্যাথিসকে হাসপাতালে একা রাখার ব্যাপারে তার মনে অন্য কোনো চিন্তা আসেনি।’

আদালতের নথি অনুসারে, ডায়েরিতে সেই দিন এবং তার পরেরদিন একটি ছোট ছেলেকে যৌন নির্যাতন এবং যৌনাঙ্গে অনুপযুক্ত স্পর্শের ব্যাপার লিপিবদ্ধ করে গেছেন জোয়েল ল্য স্কুয়ার্নেক।

ভিনেট জানিয়েছেন, হাসপাতাল থেকে ফেরার পর ম্যাথিস আর আগের মতো ছিল না। পরবর্তী জীবনে তিনি মদ্যপান এবং মাদকাসক্তিতে ডুবে যায় সে। পুলিশের কাছ থেকে নানা তথ্য জানার পর তার মনে আবার সেই নির্যাতনের স্মৃতি ফিরে আসে। এর তিন বছর পর ২০২১ সালে অতিরিক্ত মাদক গ্রহণের ফলে মাত্র ২৪ বছর বয়সে মারা যান ম্যাথিস।

মামলার বাদি ভিনেট এবং তার স্ত্রী মনে করেন, ম্যাথিস আত্মহত্যা করেছেন। তারা তাদের নাতির মৃত্যুর জন্য জোয়েল ল্য স্কুয়ার্নেককেই দোষী মনে করেন।

এই মামলাটি ফ্রান্সসহ পুরো বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। চিকিৎসা খাতে এমন গুরুতর অপরাধ রোধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও নজরদারির আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকারিভাবে হাসপাতালগুলোর নিরাপত্তা ও নৈতিকতা পর্যালোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

মানবাধিকার সংস্থা এবং সাধারণ জনগণ এই নৃশংস অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি তুলেছেন। বিচার প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই মামলার দিকে পুরো দেশের নজর থাকবে।