রাষ্ট্রভাষা থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা

আবুল মোমেন
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
রাষ্ট্রভাষা থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থাকতে পারত ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকরা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, তারা বাঙালিদের সমমর্যাদার নাগরিক হিসেবে মূল্য দেবে না। তারা হলো শাসকগোষ্ঠী আর বাঙালি থাকবে শাসিত জনগোষ্ঠী হয়ে। তাই পাকিস্তানের কাঠামোয় বাঙালি হয়েছে বঞ্চিত, উপেক্ষিত এবং নিপীড়িত। ফলে অচিরেই ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক চেতনা বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অনুপ্রেরণায় রূপ লাভ করেছে। তখন সাহিত্য, শিল্প ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সৃজনশীল মানুষ সন্ধান করেছে তার ঐতিহ্যের, তার চিরায়ত সংস্কৃতির। এই তৎপরতার মধ্য দিয়ে রাজনীতির সঙ্গে এক সময় সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটে যায়। তাতে সর্বস্তরের মানুষের জাগরণে-অংশগ্রহণে দেশব্যাপী আন্দোলনের জোয়ার আসে। তা-ই আমাদের পৌঁছে দিয়েছে বাংলাদেশের বন্দরে।

স্বাধীন বাংলাদেশে স্বভাবতই রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলো, সরকারি কাজকর্ম চলছে বাংলায়, সংবিধান রচিত হলো মাতৃভাষায়। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বস্তরেই বাংলা হলো শিক্ষার মাধ্যম। পরিভাষা তৈরি ও পারিভাষিক অভিধান রচনার কাজও শুরু হলো। স্বাধীনতার পরে আনন্দময় অভিজ্ঞতা ছিল তেল কোম্পানি এবং ব্যাংকগুলোর নামের রূপান্তর দেখা। তেল কোম্পানি তিনটির নাম হলো পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা। আর প্রধান ছয়টি ব্যাংকের ইংরেজি নাম বদলে নতুন বাংলা নাম রাখা হলোÑ সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, পূবালী, উত্তরা। এর সঙ্গে সাযুজ্য রেখে মানুষ অফিস ও দোকানের নামেও আনল পরিবর্তনÑ সর্বত্র চলছিল বাংলা ভাষার জয়জয়কার। ঊনসত্তরের গণজাগরণ থেকেই শুরু হয়েছিল নবজাতক সন্তানের নাম বাংলায় রাখা। তা অব্যাহত থাকল স্বাধীনতার পরও। তার পরই ঘটে গেল ১৯৭৫-এর আগস্ট এবং নভেম্বরের হত্যাযজ্ঞ ও পালাবদল। জাতীয়তাবাদের নতুন বাংলাদেশি চেতনার প্রকাশ ঘটল। ধর্মভিত্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তার বিরোধ ও ব্যবধানও দেখা গেল এ সময়।

আশির দশক থেকে চালু হলো ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, দোকানপাট-অফিসের নামে ইংরেজি ফিরতে শুরু করল। এ সময়ই মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের দৌলতে ইংরেজির দাপট ও রমরমা বাড়তেই থাকল। ধীরে ধীরে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে ওই এক মাস এবং পহেলা বৈশাখকে ঘিরে কয়েকদিন ছাড়া মাতৃভাষা-সংস্কৃতির বিষয়ে তেমন সচেতনতার প্রকাশ দেখা যায় না।

আজকের বাংলাদেশে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বাংলা একাডেমির বইমেলা কেবল সফলভাবেই আয়োজিত হয় না, প্রতিবছর এর কলেবর বাড়ছে, বই বিক্রিও বেড়ে চলেছে, লেখকের সংখ্যা বেড়েছে, ক্রেতার সংখ্যাও তাল রেখে বেড়ে চলেছে। কেবল সন্দেহ জাগে পাঠক নিয়ে। সাধারণভাবে মানুষের পাঠাভ্যাস কমতে দেখা যাচ্ছে। তরুণ-কিশোররা তো ইংরেজি ভাষা এবং নতুন প্রযুক্তিতে আসক্ত হয়ে পড়েছে। তাই এ বিষয়টি ধোঁয়াশাতেই রয়েছে।

এখন জেলায় জেলায়ও বইমেলা হচ্ছে, এমনকি অনেক জেলায় স্থানীয় প্রকাশক ও লেখকরাও বেশ তৎপর আছেন। এ মাসে মুদ্রণ ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমের লেখা ও অনুষ্ঠানে ভাবাবেগের প্রকাশ দেখে কে বলবে যে দেশের উচ্চ থেকে মধ্যবিত্ত সব পরিবারই সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমেই পড়াচ্ছেন! নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তারাও বড় ঝুঁকি নিয়ে ইংরেজি স্কুলেই ছুটছেন। এমনকি দেশের লেখক-বুদ্ধিজীবী, প্রগতিশীল শিল্পী-সাহিত্যিকদের পরিবারেও তো একই ধারা চলছে। তিন ধারায় যে শিক্ষা চলছে তার সব মাধ্যমেই ভাষা ও সাহিত্যের পাঠ আশানুরূপ হচ্ছে না। বাংলা মাধ্যম ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা বাংলা-ইংরেজি দুভাষাতেই দুর্বল থেকে যাচ্ছে। সব ক্ষেত্রেই ভাষাজ্ঞান দুর্বল থেকে যাচ্ছে, সাহিত্যপাঠের অভ্যাস হচ্ছে না, দেশ ও দেশের ইতিহাস সম্পর্কে তৈরি হচ্ছে বিভ্রান্তিকর ধারণা।

এটা ঠিক, আজ আমরা এক বিশ্বপল্লীতেই বাস করছি অর্থাৎ সবাই বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠছি। তাই এটাও স্বাভাবিক যে, এখনকার শিশুরা মাতৃভাষা বাংলা ও আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি শিখবে অর্থাৎ তারা দ্বিভাষিক নাগরিক হবে। কিন্তু ইংরেজি তারা শিখবে বাংলার সঙ্গে পরিপূরক ভাষা হিসেবে, কোনো অবস্থাতেই বাংলা ভাষার বিনিময়ে নয়। ভালো বাংলা এবং ভালো ইংরেজি শেখা শিশুর জন্য অসম্ভব কোনো কাজ নয়। আদতে আমাদের মনে রাখতে হবে, আজকের প্রযুক্তিনির্ভর এ জীবনে বিজ্ঞানের জ্ঞান হওয়া চাই পাকা, তাই একালের শিক্ষার্থীদের গণিতটাও খুব ভালোভাবে জানতে হবে, কেননা এ হলো বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের ভাষা। ধর্মীয় ভাষা হিসেবে আরবি, সংস্কৃত, পালি কোন বয়স থেকে শেখা যায় তা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসে ঠিক করা যায়। তবে একই সঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে দেশের ক্ষুদ্র যেসব জাতিসত্তার বাস তাদের ভাষা চর্চার বিষয়েÑ তাদের ভাষা ও লিপির বিকাশ ও প্রমিতকরণ, সেসব ভাষায় শিশুপাঠ্য গ্রন্থ ও সাহিত্যরচনার পথ প্রশস্ত করা জরুরি।

একুশ আজ কেবল শহীদ দিবস নয়, বাংলা ভাষার আন্দোলনের দিন নয়, এদিন এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তাই এদিন এ দেশের বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি অন্যান্য প্রায় ৪৬টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষার বিকাশের কথাও মাথায় রাখতে হবে।

আরও পড়ুন:

টনক নড়বে কি

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক এবং সম্পাদক, আমাদের সময়