ভাষা মানুষের প্রধান অনুষঙ্গ
পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের আত্মপরিচয়ের প্রধান মাপকাঠি হচ্ছে জাতীয়তা আর প্রধান অনুষঙ্গ ভাষা। ভাষা দিয়েই জাতীয়তার পরিচয় নির্ধারণ করা যায়। বিশ্বের অগণিত জাতিসত্তার মানুষ কে কোন জাতীয়তার সেটা নিরূপণ করা যায় ভাষার মাধ্যমেই। ভাষা মানুষের অবিচ্ছেদ্য এবং সার্বক্ষণিক সঙ্গী। ভাষাবিহীন মানুষ অচল। ভাষাই মানুষকে পরস্পরের সঙ্গে সংলগ্ন করে। পরস্পরের নৈকট্য স্থাপনেও ভাষা প্রধান ভূমিকা পালন করে। তাই ভাষাবিহীন আমরা অচল। বিশ্বের অগণিত মানুষের ভাষা অভিন্ন নয়। জাতিভেদে ভাষার ভিন্নতা রয়েছে। এমনকি একই দেশে একই জাতিসত্তার মানুষের ভিন্ন ভিন্ন স্থানীয় বা আঞ্চলিক ভাষা রয়েছে। যেগুলো বর্ণমালাহীন, মানুষের মুখে মুখে থাকে। বর্ণমালা না থাকার কারণে ওইসব ভাষা লিখিত হওয়ার উপায় থাকে না। তাই ওই ভাষার সাহিত্যও থাকে না। এসব আঞ্চলিক কথ্যভাষার পাশাপাশি জাতিগত অভিন্ন ভাষাও রয়েছে। জাতিগত ভাষাই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত। জাতি-পরিচয়ে আঞ্চলিক ভাষা নয়, রাষ্ট্রভাষাকেই গণ্য করা হয়।
এক জাতির মানুষ অপর জাতির মানুষের সঙ্গে কথোপকথনে বিকল্প ভাষার সাহায্য নেয়। কেননা একের ভাষা অন্যের জানা-বোঝা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে বিশ্বে দ্বিতীয় বা বিকল্প ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষার বহুল ও ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বব্যাপী উপনিবেশ গড়ে তুলে শত-সহস্র বছর প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে রেখেছিল। ফলে ইংরেজি ভাষা বিকল্প ভাষা হিসেবে বিশ্বজুড়ে স্থায়ী হয়ে আছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে ইংরেজি ভাষার প্রচলন ঘটিয়ে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে স্থায়ী স্মারকরূপে ইংরেজি ভাষা বিশ্বজুড়ে যেমন বিস্তার লাভ করে আছে, তেমনি বিকল্প ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বিকল্প ভাষায় সবাই যে পারদর্শী তা কিন্তু বলা যাবে না। ইংরেজ শাসকরা তাদের উপনিবেশগুলোতে মিশনারিদের নিয়ে এসে ইংরেজি শিক্ষার কার্যক্রম শুরু করে, দুটি উদ্দেশ্যে। এক. স্থানীয় ভাষার বিপরীতে ঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অভিপ্রায়ে। দুই. উপনিবেশের স্থানীয়দের যুক্ত করে শাসনকার্য পরিচালনার সহযোগী হিসেবে নিয়োগের লক্ষ্যে। কেননা একটি উপনিবেশে ব্রিটিশ নাগরিকদের এনে পুরো প্রশাসনিক, সামরিক কাজ অসম্ভব। তাই স্থানীয়দের যুক্ত করে একটি কেরানি শ্রেণি সৃষ্টি অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। সেই লক্ষ্যে স্থানীয়দের ইংরেজি শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী করে তাদের শাসনকার্যের সহযোগী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। ফলে প্রতিটি উপনিবেশে ব্রিটিশ অনুগত একটি কেরানি শ্রেণি গড়ে ওঠে। তারাই স্থানীয় শাসক-সহযোগী শ্রেণি হিসেবে ‘শিক্ষিত-সমাজ’ হিসেবে সমাজে-মর্যাদাপূর্ণ সামাজিক অবস্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছিল। সমষ্টিগত মানুষ শিক্ষাবঞ্চিত থাকার ফলে ইংরেজি ভাষা সর্বস্তরে বিস্তার লাভ করেনি। মুষ্টিমেয়দের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাই আমাদের উপমহাদেশেও ইংরেজি জানা মানুষদেরই শিক্ষিত হিসেবে গণ্য করার সংস্কৃতি আজও চালু রয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসকদের ইচ্ছাপূরণে যারা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রকে শক্তি জুগিয়ে ছিল, অভিজাত ওই শ্রেণির সঙ্গে স্থানীয় স্বদেশিদের বিস্তর দূরত্বের সৃষ্টি হয়। অনিবার্য কারণে স্থানীয়রা যেমন ঔপনিবেশিক ইংরেজ এবং স্থানীয় কেরানি শ্রেণির মিলিত শাসনাধীনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। ভাষাও যে শোষণের মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা পালন করেছিল সেটাও অসত্য নয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর ওই ইংরেজি শিক্ষিত শ্রেণিই উপনিবেশমুক্ত দেশগুলোর শাসক শ্রেণি রূপে ব্রিটিশদের আইন-কানুনের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার সুযোগ লাভ করেছিল। তাই ঔপনিবেশিক শাসনের সংস্কৃতির অবসান হয়নি। বরং ঔপনিবেশিক ভাষা-সংস্কৃতি আজও বিরাজমান।
ভাষার ভিন্নতায় অনেক সময়ই অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে। এখানে ব্যক্তিগত স্মৃতি উল্লেখ করছি। ১৯৮১ সালে ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় ঢাকা থেকে বিমানে দুটি দেশে যাত্রাবিরতির পর কুয়েত পৌঁছাই। ইরাকে যাত্রীবাহী বিমান চলমান নিষিদ্ধ থাকার ফলে কুয়েত থেকে সড়কপথে বাগদাদ যেতে হয়েছিল। কুয়েত বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে আমার স্বদেশি দুজন শ্রমিক ছুটে এসে আমাকে জানায় তাদের ইমিগ্রেশনের লোক বেরোতে দিচ্ছে না, আটকে রেখেছে। আরবি ও ইংরেজি ভাষায় প্রশ্ন করছে কিন্তু তারা ওই দুই ভাষা না জানার ফলে উত্তর দিতে পারেনি। অগত্যা আমি এগিয়ে গিয়ে ইমিগ্রেশনের লোকদের জিজ্ঞেস করি, এদের সমস্যা কী? উত্তরে জানায়, ‘তোমার এই দুই স্বদেশিকে তাদের নাম জিজ্ঞেস করলে তারা কোনো সদুত্তর না দেবার জন্য তাদের দাঁড় করিয়ে রেখেছি। তুমি দুজনকে ডেকে একে একে ওদের নাম বলতে বল।’ আমি দুজনকে ওদের সামনে দাঁড় করিয়ে একজনকে বলি তোমার নাম কী? সে বলে, তারিক মিয়া। এটা শোনামাত্র ইমিগ্রেশনের লোকগুলো তীব্র হাসিতে ফেটে পড়ে। আমিও বিস্মিত হই ওদের হাসাহাসিতে। দ্বিতীয় জনকে বলি, তোমার নাম কী, বলো? সে বলে জামাল মিয়া। এটা শুনে তারা অঙ্গভঙ্গি করে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে। অগত্যা তাদের হাসির কারণ জিজ্ঞেস করলে ইমিগ্রেশনের লোকরা বলে, ‘পাসপোর্টে ওদের নাম দেখেই বিস্ময়ে ওদের দাঁড় করিয়ে রেখেছি।’ ওদের একজনের নাম তারিক মিয়া আরবি ভাষান্তরে একশত রাস্তা। আর দ্বিতীয়জনের নাম জামাল মিয়া অর্থাৎ একশত উট। আরবি ভাষায় মিয়া হচ্ছে একশত, তারিক হচ্ছে রাস্তা, জামাল হচ্ছে উট। এরপর দুজনকে ইমিগ্রেশন থেকে অব্যাহতি দিয়ে আমিও দ্রুত স্থান ত্যাগ করি।
এ রকম ঘটনা সবার জীবনেই কমবেশি ঘটে থাকে। ভাষা আমাদের নিকটবর্তী করে। পরস্পরকে সংলগ্ন হতে সাহায্য করে। ভাষা বিচ্ছিন্নতার অবসানে সক্রিয় ভূমিকাও পালন করে। আরবীয় উপাখ্যান ‘আলীবাবা’ আমাদের উপমহাদেশে বহুল পঠিত। চলচ্চিত্র, নাটক হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। আলীবাবা কিন্তু ব্যক্তিটির নাম নয়। আরবি ভাষায় আলীবাবা অর্থ চোর। উপাখ্যানটির বঙ্গানুবাদ ‘চোর’। ভাষার বৈপরীত্যে আমরা বিভ্রান্তও হয়ে থাকি। ভাষা যে মানবজাতির প্রধান অনুষঙ্গ সেটা কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না।
আরও পড়ুন:
আওয়াজ তোলা চাই - ‘তামাক পণ্যে না’
মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত