সেবার মান ও আস্থায় এগিয়ে সোনালী ব্যাংক
২০২৪ সালে ব্যবসার বিভিন্ন সূচকে সোনালী ব্যাংক পিএলসির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে ২০২৫ সালকে ‘আস্থা আর সেবার মাধ্যমে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ার বছর’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শওকত আলী খান। সম্প্রতি আমাদের সময়কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্যাংক খাতের চলমান নানা ইস্যুতে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমাদের সময়ের সিনিয়র রিপোর্টার জিয়াদুল ইসলাম
আমাদের সময় : সোনালী ব্যাংক পিএলসি ২০২৪ সালে ব্যবসায়িকভাবে কতটা সফল?
শওকত আলী খান : ২০২৪ সাল ছিল সোনালী ব্যাংক পিএলসির ব্যবসায়িকভাবে সফলতার বছর। এ সময়ে ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফা অর্জন করেছে ব্যাংকটি, যা দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যেও সর্বোচ্চ। তবে শুধু মুনাফা অর্জনই একমাত্র লক্ষ্য নয়, এর সঙ্গে টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করে সমাজে অবদান রাখাও অন্যতম লক্ষ্য।
আমাদের সময় : আমানতের ধীর গতির কারণে বেশ কিছু ব্যাংক তারল্য সংকটে আছে- এর কারণ কী? সোনালী ব্যাংকের আমানত পরিস্থিতি কেমন?
শওকত আলী খান : উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে তাদের সঞ্চয় থেকে অর্থ তুলে নিচ্ছেন, ফলে ব্যাংকগুলোর আমানত সংগ্রহের হার কমেছে। কিছু ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতাও একটি কারণ। আবার ঋণ পরিশোধে ধীরগতি রয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট আরও বেড়েছে। তবে ব্যাংক ব্যবসায় গ্রাহকদের সেবা এবং আস্থা অর্জন খুবই গুরত্বপূর্ণ। এই জায়গাতেই সোনালী ব্যাংক অন্যদের থেকে এগিয়ে। সোনালী ব্যাংক সর্বদা গ্রাহকদের সন্তুষ্টি ও আস্থা অর্জনে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। ২০২৪ সালে এই ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ১ লাখ ৬৪ হাজার ৯৬০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১৪ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা বেশি। সোনালী ব্যাংক যে গ্রাহকের সন্তুষ্টি ও আস্থা অর্জন করতে পেরেছে, এটাই তার প্রমাণ।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
আমাদের সময় : সোনালী ব্যাংক বর্তমানে কোন কোন খাতে ঋণ বিতরণে অগ্রাধিকার দিচ্ছে?
শওকত আলী খান : ঋণ বিতরণে কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (সিএমএসএমই) খাতে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে এই খাতে ব্যাংকের মোট ঋণের পরিমাণ ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়া রপ্তানিমুখী এসএমই খাতসহ বিভিন্ন খাতে অর্থায়ন বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। সর্বোপরি সিএমএসএমই, রপ্তানিমুখী এসএমই, কৃষি ও মাইক্রো ক্রেডিট খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখছে সোনালী ব্যাংক।
আমাদের সময় : ব্যাংকিং খাতে মূল সমস্যা উচ্চ খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণ কী? এটি কমিয়ে আনতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন? সোনালী ব্যাংক কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে?
শওকত আলী খান : ব্যাংকিং খাতে উচ্চ খেলাপি ঋণ একটি প্রধান সমস্যা, যা আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পেছনে ঋণ গ্রহীতার ঋণ পরিশোধে সদিচ্ছার অভাব, ঋণের বিপরীতে অপর্যাপ্ত জামানত, প্রকৃত চাহিদার তুলনায় কম-বেশি ঋণ নেওয়া এবং ঋণগ্রহীতা কর্তৃক ঋণের অর্থ ব্যবসায়ে বিনিয়োগ না করে ভিন্ন খাতে ব্যবহার (ফান্ড ডাইভারশন) উল্লেখযোগ্য। খেলাপি কমিয়ে আনতে সুশাসন ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করে ঋণ প্রদানের প্রক্রিয়া উন্নত করা, ঋণ প্রদানের আগে ঋণগ্রহীতার সক্ষমতা ও ঝুঁকি মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত নেওয়া, খেলাপি আদায়ে কার্যকর আইন প্রয়োগ ও প্রয়োজনে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। আর সোনালী ব্যাংকও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসরণ করে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। শ্রেণিকৃত ঋণ আদায়ে ব্যাংকের সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত করে চার স্তরের কমিটি গঠন করা হয়েছে। অবলোপন ঋণ আদায়ে উচ্চ পর্যায়ে কমিটি গঠন ও কঠোর মনিটরিং করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, শ্রেণিকৃত ঋণ ও অবলোপন ঋণ আদায়ের ওপর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্য আর্থিক পুরস্কার চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ কমাতে সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ, দক্ষ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, আইনগত ব্যবস্থা জোরদার এবং এ বিষয়ে ব্যাংকারদের যথাযথ প্রশিক্ষণে সোনালী ব্যাংক কাজ করছে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
আমাদের সময় : সোনালী ব্যাংক পিএলসি ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে কতটা এগিয়েছে?
শওকত আলী খান : ডিজিটাল ব্যাংকিং হলো প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক ব্যাংকিং পদ্ধতি। সোনালী ব্যাংক পিএলসি ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। সম্প্রতি করপোরেট গ্রাহকদের জন্য ‘সোনালী করপোরেট আইব্যাংকিং’ সেবা চালু করেছে, যা তাদের ২৪/৭ অনলাইনে ব্যাংকিং সুবিধা প্রদান করে। এ ছাড়া প্রযুক্তিভিত্তিক আধুনিক সেবা প্রদানের লক্ষ্যে ‘সোনালী ই-সেবা’ মোবাইল অ্যাপস চালু করেছে, যার মাধ্যমে ‘ই-কেওয়াইসি’র আওতায় ঘরে বসে ২ মিনিটে ব্যাংক হিসাব খোলা এবং আয়কর, ভ্যাট, ট্রাভেল ট্যাক্স, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফি ইত্যাদি পরিশোধ কার্যক্রম চালু করেছে। ক্যাশলেস সোসাইটি গঠনে সোনালী ব্যাংক আরেকটি মোবাইল অ্যাপ ‘সোনালী ই-ওয়ালেট’ চালু করেছে, যার মাধ্যমে গ্রাহক ঘরে বসে এক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য অ্যাকাউন্টে টাকা প্রেরণ, সোনালীর অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য যে কোনো ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে টাকা প্রেরণ, মোবাইল রিচার্জ, ক্রেডিট কার্ডের বিল, ইউটিলিটি বিল, ডিপিএসের টাকা জমা করতে পারছে। পাশাপাশি গ্রাহকদের সার্বক্ষণিক ব্যাংকিং সেবা প্রদানে সোনালী ব্যাংক নিজস্ব কল সেন্টার (১৬৬৩৯) চালু করেছে। পেপারলেস ব্যাংকিংয়ের অংশ হিসেবে সোনালী ই-ওয়ালেট অ্যাপের মাধ্যমে কিউআর কোড ব্যবহার করে চেক বই ছাড়াই গ্রাহকরা ব্যাংকের যে কোনো শাখা হতে অর্থ উত্তোলন করতে পারছেন। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংক ‘বাংলা কিউআর কোড বেইজড’ মার্চেন্ট পেমেন্ট সুবিধাও চালু করেছে।
সোনালী ব্যাংকের ডিজিটাল ও স্মার্ট অগ্রযাত্রায় সংযোজিত ‘সোনালী এক্সচেঞ্জ’ মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে আমেরিকার ছয়টি স্টেট থেকে যেকোনো সময়ে রেমিট্যান্স প্রেরণকারী ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশের যে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং বিকাশ, নগদসহ যে কোনো মোবাইল ব্যাংকিংয়ে তাৎক্ষণিকভাবে টাকা প্রেরণ করতে পারছে।
আমাদের সময় : দেশের ব্যাংকিং খাত কী ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে কাক্সিক্ষত পর্যায়ে যেতে পেরেছে?
শওকত আলী খান : দেশের সামগ্রিক ব্যাংকিং খাত ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে উন্নতি করলেও কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছায়নি বলে মনে করি। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনবিষয়ক গাইডলাইন প্রকাশ করেছে, যা ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে। তবে, এ ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে; যেমনÑ সাইবার নিরাপত্তা, প্রযুক্তিগত অবকাঠামো ও গ্রাহকদের ডিজিটাল সক্ষমতা বৃদ্ধি। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ব্যাংকিং খাতকে ডিজিটালাইজেশনের কাক্সিক্ষত পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে।
আমাদের সময় : সোনালী ব্যাংককে কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান?
শওকত আলী খান : আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সোনালী ব্যাংক জনগণের ব্যাংক হিসেবে জনগণের সেবায় সবসময় অগ্রগামী ভূমিকা পালন করবে। ভবিষ্যতে আরও উন্নত সেবা প্রদান, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং গ্রাহক সন্তুষ্টি বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের ব্যাংকিং খাতের শীর্ষস্থানে অবস্থান করবে এই ব্যাংক।