রোজার আগেই তেলের নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না

রেজাউল রেজা
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
রোজার আগেই তেলের নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না

দুই সপ্তাহ বাদেই শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। এর মধ্যেই সয়াবিন তেলের বাজারে চলছে তেলেসমাতি। পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো বলছে- ঘাটতি নেই। বরং বাজারে সয়াবিন তেলের সরবরাহ বেড়েছে। আসন্ন রোজা উপলক্ষে পাইপলাইনে রয়েছে আরও প্রায় দেড় লাখ টন। অথচ বাজারে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। দাম বাড়লেও সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। কোনো দোকানে পাঁচ লিটারের বোতল নেই তো কোনো দোকানে এক-দুই লিটারের বোতল নেই। কোথাও আবার একেবারেই উধাও। ফলে প্রতিদিনের রান্নায় প্রয়োজনীয় এ পণ্যের সন্ধানে ভোক্তাকে ঘুরতে হচ্ছে দোকান থেকে দোকানে। বোতল পাওয়া গেলেও কিনতে হচ্ছে বাড়তি দামে। ভোজ্যতেলের বাজারে এমন ভোগান্তিতে ক্ষুব্ধ সাধারণ ভোক্তারা। অপরদিকে ডিলারের কাছ থেকে চাহিদামাফিক বোতল না পেয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে খুচরা বিক্রেতাদের।

গতকাল বুধবার রাজধানীর কদমতলী সাদ্দাম মার্কেট এলাকার অন্তত ৭টি দোকান ঘুরে দুই লিটারের বোতলের দেখা পাননি বেসরকারি চাকরিজীবী মো. এনামুল হক। শেষমেশ এক লিটার খোলা তেল কেনেন তিনি। কথা হলে এনামুল বলেন, যে দোকানেই যাই বলে বোতল নেই। কোম্পানি নাকি দিচ্ছে না। দুই দোকানে ৫ লিটারের কয়েকটা বোতল ছিল, কিন্তু পকেটে টাকা কম থাকায় কিনতে পারিনি। তিনি খেদের সঙ্গে বলেন, রোজার আগেই এমন অবস্থা! এগুলো দেখার কি কেউ নেই? এমন প্রশ্নও রাখেন।

ওই এলাকার খুচরা বিক্রেতা মো. শাজাহান মিয়া বলেন, কোম্পানির কাছে চেয়েও বোতল পাচ্ছি না। নিয়মিত ক্রেতাদের জন্যও তো কিছু বোতল প্রয়োজন, সেটুকুও পাচ্ছি না। ফলে ক্রেতারাও অন্য দোকানে চলে যাচ্ছেন। কেউ কেউ নানা কথাও শুনিয়ে যাচ্ছেন। দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে কোম্পানি। আর বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে আমাদের।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) তথ্যানুযায়ী, দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন। রমজানে চাহিদা বেশি থাকে- ১ লাখ ৮০ হাজার থেকে ৩ লাখ টন।

বাজারে সয়াবিনের সংকট নিয়ে কথা বলেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিনও। গতকাল সচিবালয়ে নৌ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, রমজানের পণ্যগুলোর মধ্যে শুধু তেলে একটা সমস্যা বিরাজ করছে। আশা করি আগামী সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে তেলের বাজার স্থিতিশীল থেকে নিম্নমুখী হয়ে যাবে এবং সরবরাহের ঘাটতি দূর হবে।

রাজধানীর কারওয়ানবাজার ও মালিবাগ বাজারেও একই চিত্র। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম আরও বাড়াতেই আগের কায়দায় কোম্পানিগুলো এমনটা করছে। বাজারে যেটুকু সয়াবিন তেলের সরবরাহ হয়, তা নিমিষেই ফুরিয়ে যাচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ী বোতলই পাচ্ছেন না।

মালিবাগ বাজারের বিপ্লব স্টোরের খুচরা বিক্রেতা মো. সোলায়মান হোসেন বলেন, কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে তো বোতলই পাই না। যদিও বা কিছু পাই তার সঙ্গে পোলাউয়ের চালের প্যাকেট ‘মাস্ট’ ধরিয়ে দেন ডিলাররা। কিনতেই হবে। এ নিয়ে ঝামেলায় আছি।

কারওয়ানবাজারের কিচেন মার্কেটের বিউটি স্টোরের ব্যবসায়ী জাকির হোসাইন বলেন, দাম বাড়ানোর পরও সরবরাহ বাড়াননি ডিলাররা। বাজারে যে পরিমাণ তেল ঢোকে তা মুহূর্তেই শেষ হয়ে যায়। অনেক দোকানি পায়ও না।

খোলা সয়াবিন তেলের মোকাম রাজধানীর মৌলভীবাজারেও তেলের সরবরাহ কমে গেছে। আগের মতো সরবরাহ না থাকায় এমনটা হয়েছে এবং দামও বাড়তি রয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা। যদিও পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো উল্টো দাবি করছে, বাজারে আগের চেয়ে সরবরাহ বেড়েছে। শুধু তাই নয়, আসন্ন রমজান উপলক্ষে আরও ভোজ্যতেল পাইপলাইনে রয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা। বিটিটিসির কার্যালয়ে গত রবিবার অনুষ্ঠিত ভোজ্যতেলের সরবরাহ পরিস্থিতি পর্যালোচনাবিষয়ক এক বৈঠকে দেশের ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী দেশীয় কারখানাগুলোর প্রতিনিধিরা এমনটাই জানান।

বিটিটিসিকে সিটি গ্রুপ জানায়, প্রতিষ্ঠানটি গত জানুয়ারিতে প্রায় ৫০ হাজার ৭০০ টন তেল সরবরাহ করেছে। এর মধ্যে ২২ হাজার ২৪২ টন বোতলজাতকৃত। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে সরবরাহ ছিল ১৪ হাজার ২৬২ টন তেল। মেঘনা গ্রুপ জানায়, গত জানুয়ারিতে মোট ৪৭ হাজার ৬৬৮ হাজার টন তেল সরবরাহ করেছে তারা। এর মধ্যে ১৫ হাজার টন বোতলজাত। গত বছর জানুয়ারিতে সরবরাহ ছিল ২৫ হাজার টন। যেখানে বোতলজাত ছিল ১২ হাজার টন। টিকে গ্রুপ জানায়, গত জানুয়ারিতে ১১ হাজার ৮১০ টন বোতলজাত সয়াবিন তেল সরবরাহ করেছে তারা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৯ হাজার ৫০০ টন। অন্যান্য উৎপাদনকারীও সরবরাহ বাড়িয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

এদিকে রমজান উপলক্ষে প্রায় দেড় লাখ টন ভোজ্যতেল ভর্তি জাহাজ চট্টগ্রামের বন্দরে নোঙর করার অপেক্ষায় আছে। এই তেল শিগগিরই সরবরাহ ব্যবস্থায় যুক্ত হবে। এর পরও বাজারে সংকট কেন, তা জানেন না ব্যবসায়ীরা। তবে তাদের ধারণা- মাঠপর্যায়ে কেউ অতিরিক্ত মজুদ করে থাকতে পারেন। কেউ কেউ অধিক লাভের আশায় হয়তো বোতল কেটে খোলা হিসাবে বিক্রি করতে পারে। তা ছাড়া প্রতিবেশী দেশে মূল্য বেশি হওয়ায় সেখানেও ‘বাণিজ্য’ হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।

তবে বিটিটিসি বলছে, বাজারে ভোজ্যতেলের কোনো ঘাটতি নেই। যেটি হয়েছে তা কৃত্রিম সংকট এবং প্রকৃত তথ্যের ঘাটতি থেকে তা সৃষ্ট। কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ভোজ্যতেলের আমদানি প্রায় ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। ঋণপত্রও (এলসি) একই হারে বেড়েছে। শুধু তাই নয়, বিশ্ববাজারেও এখন পণ্যটির মূল্য স্থিতিশীল।

বারবার একই কায়দায় বাজারে অস্থিরতা দেখা দিলেও এ থেকে পরিত্রাণ মিলছে না। এর পেছনে ট্যারিফ কমিশনসহ অন্যান্য সংস্থার ব্যর্থতাই দায়ী বলে মনে করেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন। তিনি বলেন, বিটিটিসির বৈঠকে ব্যবসায়ীরা জানালেন সরবরাহ বেড়েছে, কিন্তু সংকট কেন তা জানেন না। তারা তো এভাবে দায় এড়াতে পারেন না। ডিস্ট্রিবিউটররা তেল নিয়ে কি করেছে সেটা দেখার দায়িত্বও তাদেরই। এভাবেই কোম্পানি-ডিস্ট্রিবিউটর মিলে ভোক্তার পকেট কাটে। ট্যারিফ কমিশন তদন্তের কথা বলছে, কিন্তু কেন এই সংকট সেটা বের হচ্ছে না। উপদেষ্টা বলেছেন যে দশ দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এই দশ দিনে যে ভোক্তা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সেটার কি হবে?