নিরাপত্তা ঝুঁকিতে নিরাপত্তা বাহিনী

শাহজাহান আকন্দ শুভ ও সাজ্জাদ মাহমুদ খান
০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
নিরাপত্তা ঝুঁকিতে নিরাপত্তা বাহিনী

নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন এবং আসামি ধরতে গিয়ে হামলার শিকার হচ্ছে পুলিশ। গ্রেপ্তার আসামিকে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। গত রবিবার একদিনে দেশের তিনটি জেলায় পুলিশের ওপর হামলা ও আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। গোপালগঞ্জে পুলিশের ওপর হামলার জেরে রবিবার রাতভর টুঙ্গিপাড়া থানা সাঁজোয়া যান দিয়ে পাহারা দেয় সেনাবাহিনী। এদিকে হামলার ঘটনার ফলে যে কোনো অভিযানে যেতে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে পুলিশকে। রাত্রিকালীন ও দুর্গম এলাকায় অভিযানে যেতে পুলিশের একটি অংশের অনীহার তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন আক্রান্ত হওয়ার প্রভাব দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলার ওপর পড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ ওমর ফারুক আমাদের সময়কে বলেন, জুলাই-আগস্টের ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবল দুর্বল হয়ে গেছে। সে সময় অবৈধ বলপ্রয়োগের কারণে তাদের অনেকেই নিজেদের অপরাধী মনে করে। তাই এখন বৈধ আইন প্রয়োগও ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে পুলিশ এবং আইন প্রয়োগ করতে গেলে তারা জনগণের আক্রোশের শিকার হতে পারে বলে মনে করছে। আইনগত অধিকার প্রয়োগও আত্মনিয়ন্ত্রণ রেখে করতে চাইছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে আসামি ছিনতাই হয়ে যাওয়ার ঘটনায় সেই অনিয়ন্ত্রিত অবস্থার প্রমাণ মেলে।

তিনি আরও বলেন, অপরাধীরা মনে করছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একটি দুর্বল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে জনগণ উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে। কমিউনিটির সঙ্গে পুলিশের সংযোগ সেই অর্থে নেই। এখন পুলিশকে কমিউনিটি লিডারদের মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক সামাজিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। জনগণকে সক্রিয় ও সচেতন করতে হবে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, রাত্রিকালীন অভিযান ও দুর্গম এলাকায় আসামি ধরতে গেলে পুলিশ শঙ্কার মধ্যে থাকে। অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিছু ক্ষেত্রে এই ধরনের অভিযানে যেতে পুলিশ সদস্যরা গড়িমসি করেন। গত সপ্তাহে আসামি ধরতে গিয়ে হামলার শিকার হয় তাদের টিম। পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে গেছে। পুলিশের যে বৈধ ক্ষমতা আছে সেটা প্রয়োগ করতেও ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন অনেক পুলিশ সদস্য। অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটলে চাকরিও যাবে, জেলও খাটতে হবে। ফলে পুলিশ যতটা সম্ভব ঝামেলা এড়িয়ে আইনি দায়িত্ব পালন করছে।

গত ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর নিউমার্কেট থানার সামনে পুলিশের ওপর হামলা করে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হোসাইন মিথুনকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালায় তার সমর্থকরা। হামলায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সহকারী কমিশনার (এসি) তারিক লতিফসহ পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হন। এ ঘটনায় মিথুন ও দলটির সহসাধারণ সম্পাদক রিয়াজুল হাসান ওরফে রাসেলকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়।

৬ জানুয়ারি ভোলার বোরহানউদ্দিনে ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিকে ধরতে গিয়ে হামলার শিকার হয়ে গুরুতর আহত হন পুলিশের অতিরিক্ত উপপরিদর্শক (এএসআই) আলমাস ও নুরুল ইসলাম। তাদের এলোপাতাড়ি মারধর ও ছুরি দিয়ে মাথায়, হাতে ও পিঠে আঘাত করা হয়। ৭ ডিসেম্বর নড়াইলের কালিয়া উপজেলায় হত্যা মামলার আসামি ছাব্বির শেখকে পুলিশের কাছ থেকে হাতকড়া পরা অবস্থায় ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ৫ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে হাতকড়াসহ দুই মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তারের পর তার সহযোগীরা পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়।

একই দিন ৩ জেলায় পুলিশের ওপর হামলা : রবিবার রাতে ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরে সুমন নামে অপহরণ মামলার এক আসামিকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় আসামিপক্ষের লোকজন। এ সময় তারা পুলিশকে প্রায় দুই ঘণ্টা ঘেরাও করে রাখে। ভাঙচুর করা হয় পুলিশের ব্যবহৃত মাইক্রোবাস। খবর পেয়ে আরও একটি পুলিশ দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে অবরুদ্ধ পুলিশ দলকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে।

রবিবার সন্ধ্যায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় আটক ব্যক্তিকে ছিনিয়ে নিতে পুলিশের ওপর হামলা ও পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর হয়। এ ঘটনার পর রাতভর সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যান টুঙ্গিপাড়া থানা পাহারা দেয়। একই দিন বিকালে পাবনার সুজানগর উপজেলায় পুলিশের গাড়ি থামিয়ে বিস্ফোরক মামলায় গ্রেপ্তার আওয়ামী লীগের এক নেতাকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে।

পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর আমাদের সময়কে বলেন, পুলিশ পেশাগত দায়িত্ব পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পুলিশের আইনি দায়িত্ব পালনে যারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে, ছাড় দেওয়া হবে না। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে নিরাপত্তার শঙ্কা নেই। আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশ বদ্ধপরিকর।

টুঙ্গিপাড়া থানার নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী : আমাদের সময়ের গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, রবিবার সন্ধ্যায় টুঙ্গিপাড়া থানা পুলিশের ওপর হামলার ঘটনার পর রাতে টুঙ্গিপাড়া থানা ঘিরে অবস্থান নেয় সেনাবাহিনী। এ ছাড়া অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সেনাবাহিনীকে টহল দিতেও দেখা যায়। গতকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত সাঁজোয়া যান নিয়ে টুঙ্গিপাড়া থানার সামনে অবস্থান করেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে টুঙ্গিপাড়া উপজেলার খান সাহেব শেখ মোশাররফ হোসেন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে আওয়ামী লীগের লিফলেট বিতরণের সময় এক ব্যক্তিকে আটকের জের ধরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ঘটনায় একজনকে আটক করা হয়েছে। সংঘর্ষের সময় ৫ পুলিশ সদস্য আহত হন। টুঙ্গিপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খোরশেদ আলম বলেন, হামলাকারীরা স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থক।

পুলিশ ও স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রবিবার সন্ধ্যায় খান সাহেব শেখ মোশাররফ হোসেন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা লিফলেট বিতরণ করছেন, এমন খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। এ সময় লিফলেট বিতরণ বন্ধ করতে গেলে পুলিশের সঙ্গে তাদের বাগ্বিত-া হয়। একপর্যায়ে পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে স্থানীয় সাফায়েত গাজীকে আটক করে নিয়ে যাচ্ছিল পুলিশ। এ সময় পুলিশের গাড়ি আটকে এবং একজন পুলিশ সদস্যকে অবরুদ্ধ করে তাদের ওপর হামলা চালায় স্থানীয়রা। পরে থানার অন্য পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছালে তারাও তোপের মুখে পড়েন। পরে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ঘটনাস্থলে পৌঁছে অবরুদ্ধ পুলিশ সদস্যকে ছাড়িয়ে নেন।

এদিকে ঘটনার পর থেকে গ্রেপ্তার আতঙ্কে রয়েছে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। ওই এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। ঘটনার পর থেকেই নিরাপত্তা দিতে বেশ কয়েকটি সাঁজোয়া যান নিয়ে টুঙ্গিপাড়া থানার সামনে সারারাত অবস্থান করে সেনাবাহিনী।

টুঙ্গিপাড়া থানার ওসি খোরশেদ আলম বলেন, আমাদের থানাসহ সব পুলিশ সদস্যের নিরাপত্তাজনিত কারণে সাঁজোয়া যান নিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা থানার চারপাশে অবস্থান করেছেন। হামলায় ৫ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় ১০৫ জনের নামসহ অজ্ঞাত সাড়ে চারশ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। আসামি গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

টুঙ্গিপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. মঈনুল হক বলেন, পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর ও একজন পুলিশ সদস্যকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে এমন সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থলে যাই। পরে উত্তেজিত জনতাকে বুঝিয়ে শান্ত করে সেই পুলিশ সদস্যকে ছাড়িয়ে ওসির কাছে পৌঁছে দিই। বর্তমানে এলাকার পরিস্থিতি শান্ত। দুপুরের দিকেও টুঙ্গিপাড়া থানার সামনে এবং আশপাশের সেনাবাহিনীর টহল দেখা গেছে।