আরও মুক্তিপণ না দেওয়ায় দুই বন্ধুকে গুলি করে হত্যা

ভাঙ্গা (ফরিদপুর) প্রতিনিধি
০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:০০
শেয়ার :
আরও মুক্তিপণ না দেওয়ায় দুই বন্ধুকে গুলি করে হত্যা

দুই বন্ধুর স্বপ্ন ছিল ইউরোপে পাড়ি জমাবে। কিন্তু স্বপ্ন নিমিষেই ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল। মুক্তিপণ দেওয়ার পর আরও মুক্তিপণ চায় দালাল চক্র। তাদের কাঙ্খিত মুক্তিপণ না দেওয়ায় দুই বন্ধুকে গুলি করে হত্যা করে মরদেহ ফেলে দিয়েছেন বলে অভিযোগ পরিবারের।

দুই বন্ধুর পরিবার ও এলাকাবাসীর কাছে মোবাইল ফোনে শেষ কথা বলে ওসিয়ত করে বলে গেছেন যে, এদের মৃত্যুর হলে তার জন্য এলাকার দালালরা দায়ী থাকবেন।

লিবিয়া থেকে গেম দেওয়ার কথা বলে সাগর পাড়ে নিয়ে গুলি করে মরদেহ গুম করেছে দালাল চক্র। এমন অভিযোগ পরিবারের।

এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটেছে ভাঙ্গায় দুটি পরিবারের মাঝে। দালাল চক্রের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে এলাকাবাসী।

গতকাল শুক্রবার রাতে পরিবারের কাছে মরদেহের ছবি আসে। এরপর থেকে এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে তাদের পরিবার ও স্বজনদের আহাজারিতে।

নিহত ২ বন্ধুরা হচ্ছে ভাঙ্গা উপজেলার ঘারুয়া ইউনিয়নের কুমারখালী গ্রামের মিন্টু হাওলাদার এর ছেলে হৃদয় হাওলাদার(২২) ও মজিবর হাওলাদারের ছেলে আকাশ হাওলাদার(২৩)।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মূল দালাল জুলহাস। তিনি কুমারখালী গ্রামের আনোয়ার মাতুব্বর ও আবুতারা মাতুব্বরের নিকট আত্মীয়। এরা দুই ভাই মূল দালালের প্রতিনিধি হিসেবে ইতালি যাওয়ার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করেন মিন্টু হাওলাদার ও মজিবর হাওলাদারকে। ইতালি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে ১৬ লক্ষ টাকায় চুক্তি হয়। আনোয়ার মাতুব্বরের কাছে ৩২ লক্ষ টাকা বুঝিয়ে দেন হৃদয় ও আকাশের পরিবার। বিশ্বাস অর্জনের জন্য আনোয়ার তার এক ভাতিজাকে হৃদয় ও আকাশের সঙ্গে পাঠায়। গত দুই মাস আগে (২০২৪ সালের ডিসেম্বরে প্রথম সপ্তাহে) একই গ্রাম থেকে তিন যুবক লিবিয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে রওনা হন। প্রথমে তাদেরকে দুবাই নেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে সৌদি আরব এরপর লিবিয়ায় অবস্থান করান। লিবিয়ায় প্রায় ১৫ দিন গেম ঘরে আটকিয়ে রেখে জুলহাস নামের সেই দালাল দুই যুবকের জন্য আনোয়ারকে দিয়ে তাদের পরিবারের নিকট আরও ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। হৃদয় ও আকাশ ১৬ লক্ষ টাকা জোগাড় করে দেওয়ার পর তারা আরও ৫০ হাজার টাকা করে দাবি করা হয়। দালাল চক্র কাঙ্খিত টাকা না পেয়ে দুই যুবকের ওপর ক্ষিপ্ত হয় এবং তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে। এরপর থেকে সুযোগ হলে তাদের ট্রলারে করে সাগর পাড়ি দিবেন বলে জানান। এভাবেই কালক্ষেপণ করতে থাকে দালাল চক্র। গত সোমবার স্থানীয় দালাল আনোয়ারের ভাতিজাকে বাদ রেখে হৃদয় ও আকাশকে গেম দেয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের করে তারা। তখনই হৃদয়ে আকাশের ভেতরে সন্দেহ হয়। তখন ২ বন্ধু তার বাবা-মায়ের সঙ্গে শেষ কথা বলেন। তারা এলাকাবাসী ও বাবা মায়ের কাছে দোয়া চান এবং শেষ নসিহত করেন, তাদের সঙ্গে যে অত্যাচার করা হয়েছে, সেই অত্যাচারের জন্য স্থানীয় দালাল চক্রের প্রতিনিধিদের বিচারের জন্য দায়ী করে যান।

এদিকে এরপর গত চারদিন হয়ে যায়, কিন্তু দুই বন্ধুর কোনো খোঁজ খবর না মিললে পরিবারের মধ্যে কান্নাকাটির রোল পড়ে যায়। হঠাৎ করে গতকাল শুক্রবার রাতে দুই যুবকের মরদেহের ছবি মোবাইলে দেখতে পান তারা। এমন ছবি অনেকের মোবাইলে দেখা গেলে হৃদয় ও আকাশ নাই বলে নিশ্চিত হন। তখন থেকে এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। শতশত লোকজন ও আত্মীয় স্বজনরা সান্তনা দিতে তাদের গ্রামের বাড়িতে ভিড় করেন। স্বজনদের মাঝে চলে শোকের মাতম। ছেলের ছবি বুকে জড়িয়ে বারবার মূর্চ্ছ্বা যাচ্ছেন নিহত যুবকদের মায়েরা।

এ ঘটনায় হৃদয়ের বাবা মিন্টু হাওলাদার বলেন, ‘আমার ছেলে হৃদয় ও ওর বন্ধু আকাশকে স্থানীয় দালাল আনোয়ার মাতুব্বর ও আবুতারা মাতুব্বর জিম্মা নিয়ে পাঠিয়েছে। তারা আমার ছেলেকে গেম ঘরে আটকে রেখে আবার টাকা দাবি করে। পরে আমি আরও ৫০ হাজার টাকা দিয়েছি। তারপরেও আমার ছেলেকে ওরা গেমের কথা বলে সাগরপাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। এমন খবর আমরা পেয়েছি তিনদিন পরে । আমার ছেলে ফোনে বলে গেছে, দালাল চক্ররাই এর জন্য দায়ী। আমি এই দালাল চক্রের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি জানাচ্ছি।’

এ ঘটনায় ভাংগা থানার অফিসার ইনচার্জ মোকছেদুর রহমান জানান, শুনেছি দুই যুবককে ইতালি নেওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় মেরে ফেলা হয়েছে। আমরা এখনো কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।