লালফিতার দৌরাত্ম্য কমাতে কমিশন গঠনের সুপারিশ
দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার এবং বিদেশি বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টিকারী অত্যধিক নিয়ন্ত্রণমূলক ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করতে নতুন একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেছে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণে গঠিত টাস্কফোর্স। নতুন এই কমিশনের নাম হবে নিয়ন্ত্রণ সংস্কার কমিশন (আরআরসি)। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করা এক প্রতিবেদনে নতুন এই কমিশন গঠন অত্যন্ত জরুরি বলে সুপারিশ করেছে টাস্কফোর্স। বৃহস্পতিবার ‘অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্গঠন এবং সমতা ও টেকসই উন্নয়নের জন্য সম্পদ সংগ্রহ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রস্তাবিত কমিশন আরআরসি ব্যবসায়িক কার্যক্রম, কর ব্যবস্থা এবং বাণিজ্য সংক্রান্ত নিয়ম-কানুন পর্যবেক্ষণ, মূল্যায়ন ও সহজীকরণের দায়িত্ব পালন করবে। এছাড়াও আরআরসি রাজস্ব বিভাগের মতো কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত কাগজপত্র, জটিল শর্তাবলিসহ নিয়ন্ত্রণমূলক অদক্ষতাগুলো চিহ্নিত করবে। সংস্থাটি সরকার এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর কাছে এই চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরবে। আরআরসি এমন সংস্কারের পক্ষে কথা বলবে, যা ব্যবসায়িক পরিবেশকে আরও অনুকূল করে তুলবে।
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন বলছে, এই উদ্যোগ বাংলাদেশে ব্যবসা বাড়ানোর পাশাপাশি দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় পরিবেশ নিশ্চিত করবে।
টাস্কফোর্স সদস্যরা বলছেন, সংস্কার এজেন্ডাগুলো অবিলম্বে বাস্তবায়নের জন্য গ্রহণ করা যেতে পারে। বিশেষ করে, সহজে অর্জনযোগ্য বেশ কিছু পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। অন্যদিকে যেগুলোকে উচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, সেগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদে শেষ না করতে পারলেও সেগুলো শুরু করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন তারা।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
পাঁচটি খাত পরীক্ষামূলক সংস্কারের সুপারিশ : সরকারি হাসপাতাল, প্রান্তিক সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা (বিআরটিএ), বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুজ্জীবিতকরণ এবং একটি মন্ত্রণালয় পরীক্ষামূলক সংস্কারের সুপারিশ করেছে টাস্কফোর্স। প্রতিবেদনে টাস্কফোর্সের সদস্যরা দাবি করেছেন, প্রাথমিক পর্যায় থেকে এর ইতিবাচক ফল জনগণকে একটি সম্ভাবনা দেখাবে, যা পরবর্তী সরকারকেও সংস্কার চালিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ তৈরি করবে। যুব ও নাগরিক গোষ্ঠীগুলোকে যথেষ্ট সংগঠিত করা গেলে সংস্কারের পক্ষে জনমত বাড়বে বলেও মন্তব্য করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
নতুন গবেষণা প্রতিষ্ঠান গঠনের তাগিদ : টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে নতুন বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণার জন্য আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে একটি গ্লোবাল এক্সিলেন্স সেন্টার প্রতিষ্ঠা করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি সফল
হলে ভবিষ্যতে পরিবেশ বিজ্ঞান, নবায়নযোগ্য শক্তি এবং জৈবপ্রযুক্তির মতো অন্যান্য শাখায় বাংলাদেশকে একটি উন্নত গবেষণা ও শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। এছাড়া সামাজিক ও আচরণগত পরিবর্তন যোগাযোগ এবং গবেষণার জন্য একটি স্বাধীন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে টাস্কফোর্স। তারা মনে করে, এই কেন্দ্রটি যোগাযোগ পদ্ধতিগুলোকে আধুনিকীকরণে ফোকাস করবে, যা সামাজিক পরিবর্তন, মনোভাব, নিয়ম এবং অনুশীলনকে এগিয়ে নেবে।
এনবিআরে নজরদারি, নতুন বিমান সংস্থার প্রস্তাব : বাংলাদেশ বিমানের ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণে নতুন একটি বিমান সংস্থার প্রস্তাব করেছে টাস্কফোর্স। নতুন এই সংস্থার জন্য বাংলাদেশ এয়ারওয়েজ নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের জাতীয় বিমান সংস্থা বাংলাদেশ বিমান আধুনিক বিমান চলাচলের মানদ- এবং কর্মদক্ষতার মাপকাঠি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। যদি বিমান ধারাবাহিকভাবে এই লক্ষ্যগুলো পূরণে ব্যর্থ হয়, তাহলে আমরা প্রস্তাব করছি একটি সম্পূর্ণ নতুন বিমান সংস্থা প্রতিষ্ঠা করার। তবে এটি পরিচালনা করবে একটি স্বাধীন ও বিশ্বমানের ব্যবস্থাপনা সংস্থা।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে তদারকির আওতায় আনতে কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে টাস্কফোর্স বলছে, একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি অবিলম্বে গঠন করা উচিত, যেখানে বেসরকারি খাত, সুশীল সমাজ এবং সরকারের সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এই কমিটির মূল দায়িত্ব হবে এনবিআরের পুনর্গঠন সম্পর্কে মূল্যায়ন, বিশ্লেষণ এবং প্রধান উপদেষ্টাকে সুপারিশ করা, যাতে কাস্টমস, ভ্যাট এবং কর সংক্রান্ত অসঙ্গতিপূর্ণ, স্বেচ্ছাচারী এবং বৈষম্যমূলক নীতি বা নিয়ন্ত্রণমূলক বাধাগুলো দূর করা যায়। শুধু রাজস্ব সংগ্রহে মনোনিবেশ করার পরিবর্তে এ ধরনের উদ্ভাবনী কর্মকা-গুলোকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেছে টাস্কফোর্স।
স্বাস্থ্য-শিক্ষাসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধিতে জোর : ডিজিটাল এবং এআই প্রযুক্তির বহুমুখী ব্যবহারের সুপারিশ করেছে টাস্কফোর্স। এতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর ওপর নজর দেওয়া হয়েছে। এসব খাতে ডিজিটাল এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার নিশ্চিত করতে একটি বড় ধরনের কৌশলগত জোর দেওয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছে টাস্কফোর্স। উদাহরণ হিসেবে তারা বলছে, স্যাটেলাইট সেন্সিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসলের জন্য প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব, যা কৃষি পদ্ধতিকে উন্নত করতে সাহায্য করবে। একইভাবে, দূরশিক্ষণের মাধ্যমে ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে শিক্ষার প্রসার সম্ভব। এছাড়া শহরের পরিবহন সেবা উন্নত করতে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা এবং একটি সংস্থার মালিকানায় সকল বাস কার্যক্রমের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এই দেশের বাণিজ্যিক অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্যকরণ, বিনিয়োগ প্রক্রিয়া উন্নত করা, স্বাস্থ্য খাতে বিদেশি বিনিয়োগ উন্মুক্তকরণ এবং কারিগরি শিক্ষার মান উন্নয়নে জোর দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। প্রতিবেদন বলছে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নকে ত্বরান্বিত হবে।
উল্লেখ্য, গণ-আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতনের পর বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে যাত্রা করা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে গত ১০ সেপ্টেম্বর ১২ সদস্যের এই টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল। ন্যায্য, টেকসই ও গতিশীল অর্থনীতির ভিত তৈরিতে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির তিন মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরির কথা ছিল। সেই প্রতিবেদন বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেওয়া হয়েছে।