শৌচাগারের টাকাতেও ভাগ শাহরিয়ার-ঘনিষ্ঠদের

জিয়াউল গনি সেলিম, রাজশাহী
২৯ জানুয়ারী ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
শৌচাগারের টাকাতেও ভাগ শাহরিয়ার-ঘনিষ্ঠদের

রাজশাহী-৬ (চারঘাট-বাঘা) আসনে আওয়ামী লীগের দাপুটে এমপি ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তার আমলে টিআর-কাবিখায় বরাদ্দ টাকার প্রায় সবই লোপাট হয়েছে। প্রকল্পের নামে সরকারি টাকা লুটেপুটে খেয়েছেন দলীয় নেতাকর্মীরা। এমনকি টয়লেট (শৌচাগার) নির্মাণের টাকাতেও ভাগ বসিয়েছেন তারা। গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার প্রকল্পের আওতায় শৌচাগার নির্মাণের নামে কোটি টাকা নয়ছয় করেছেন তারা। এই প্রকল্পে কোনো রকম টেন্ডার ছাড়াই দলীয় নেতাকর্মীদের দিয়ে ৪২টি শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলো বাস্তবে কোনো কাজে আসেনি। ব্যবহারের আগেই এগুলো পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে।

চারঘাট ও বাঘা উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, কাবিটা (গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার) প্রকল্পের আওতায় ২০২০-২০২১ অর্থবছরে দুই উপজেলার ৪২টি কমিউনিটি ক্লিনিকে শৌচাগার (ওয়াশব্লক) নির্মাণ করা হয়। নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় এক কোটি ৫ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। প্রতিটি শৌচাগারে ব্যয় ধরা হয় আড়াই লাখ টাকা। এতে নারী ও পুরুষদের জন্য পৃথক টয়লেট, ওয়াশরুম ও ১টি বেসিন স্থাপন করা হয়। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি ২০২২ সালে নির্মাণকাজ শেষ করলেও ব্যবহার করা যায়নি সেগুলো।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২০২১ সালে (চারঘাট-বাঘা) সংসদীয় আসনে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কারের জন্য বরাদ্দের পুরো টাকাই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে শৌচাগার নির্মাণে ব্যয় করা হয়। মূলত টাকাগুলো খরচের জন্য তড়িঘড়ি করে লোকদেখানো প্রকল্প নেওয়া হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে সেবাগ্রহীতাদের যাতায়াত কিংবা সার্বিক অবস্থা যাচাই-বাছাই না করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ছাড়া নির্মাণের সময় নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে ত্রুটিপূর্ণ কাজ করা হয়েছে। ফলে বছর না ঘুরতেই সব শৌচাগারই অকেজো হয়ে পড়ে।

সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা যায়, সব কমিউনিটি ক্লিনিকের শৌচাগারে তালা ঝুলছে। অধিকাংশ তালায় মরিচা ধরেছে। নির্মাণের দুই বছর অতিবাহিত হলেও অধিকাংশ ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ এখনও এগুলো বুঝে পাননি। যারা পেয়েছেন, তারা ব্যবহার করতে পারছেন না। কোনোটিতে পানির ব্যবস্থা নেই, আবার কোনোটিতে পানির ব্যবস্থা থাকলেও বুঝে নেওয়ার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। আবার কোনোটিতে পানির লাইন ও শৌচাগারের প্যান ত্রুটিপূর্ণভাবে স্থাপন করায় তা ব্যবহার অনুপযোগী। এভাবে সব শৌচাগার অকেজো হয়ে পড়ে আছে। শৌচাগারগুলোর পানির লাইন দেওয়া হয়েছে আশপাশের অগভীর নলকূপের ট্যাংকি থেকে।

চারঘাট উপজেলার ঝিকরা কমিউনিটি ক্লিনিকে আসা এক নারী বলেন, ক্লিনিকে নতুন শৌচাগার থাকলেও ব্যবহারের অনুপযোগী। পানি না থাকায় ব্যবহার করা যাচ্ছ না। চারঘাটের হাবিবপুর গ্রামের মোত্তাকিন আলী বলেন, গ্রামের নারীরা কেউ কমিউনিটি ক্লিনিকে যেতে চায় না। যারা সেবা নিতে যায়, প্রয়োজন হলেও টয়লেট ব্যবহার করতে পারেন না।

ঝিকরা কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) আকতার বানু বলেন, আড়াই বছর আগে শৌচাগারের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এরপর থেকেই তালাবদ্ধ। চাবিটাও দিয়ে যায়নি। তা ছাড়া শৌচাগারের প্যান, পানির লাইন, টাইলস সবই নিম্নমানের। ফলে রোগীরা ব্যবহার করতে পারছেন না।

বাঘা উপজেলার আড়পাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডার ফিরোজা খাতুন বলেন, শৌচাগার নির্মাণ করলেও পানির ব্যবস্থা না থাকায় অকেজো হয়ে পড়ে আছে। রোগীদের নিয়ে অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়তে হয়।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের চারঘাট উপজেলা শাখার সহসভাপতি আঞ্জুমনোয়ারা ময়না বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে যারা সেবা গ্রহণ করেন, তাদের অধিকাংশই নারী। মাতৃসেবাসহ বিভিন্ন সেবা ও ওষুধ গ্রহণ করেন তারা। তাদের জন্য শৌচাগার নির্মাণের নামে প্রকল্প নিয়ে লুটপাট করা হয়েছে। নির্মাণের সময় আমরা মতামত দিলেও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। নিম্নমানের নির্মাণকাজের কারণে এখন সব অকেজো।

চারঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তৌফিক রেজা বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে ৩০ রকমের ওষুধ সরবরাহ থাকে। একবারে গ্রামীণ রোগী যারা সবসময় উপজেলা সদরে আসতে পারেন না, তারা সেখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা ও ওষুধ গ্রহণ করেন। সেবাগ্রহীতা রোগী ও তাদের স্বজনদের জন্য শৌচাগার গুরুত্বপূর্ণ। নতুন শৌচাগার নির্মাণ হলেও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

চারঘাট উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ফরহাদ লতিফ আমাদের সময়কে বলেন, আমরা নির্মাণের পর এগুলো বুঝিয়ে দিয়েছি। এখন কেন ব্যবহার করা যাচ্ছে না, বলতে পারছি না। দেখি কী করা যায়।

বাঘা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মাহমুদুল ইসলাম বলেন, পিআইসির বরাদ্দ দেন এমপিরা। এখানে টেন্ডারের সুযোগ নেই। তখন কাজগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। কয়েক বছর অতিবাহিত হয়ে যাওয়ায় টয়লেটগুলো ভালো থাকার কথা না।