গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিতের তাগিদ
বাংলাদেশে দ্রুত ও কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের অর্জিত অগ্রগতি ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্যই সংস্কারের প্রয়োজন। নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) তাদের এক প্রতিবেদনে এসব বলেছে। ‘আফটার দ্য মুনসুন রেভল্যুশন : আ রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনটি গতকাল প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে ২০২৪ সালের আগস্টে স্বৈরাচারী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর বাংলাদেশের পদ্ধতিগত সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে ক্ষমতার পৃথকীকরণ এবং জনপ্রশাসন, পুলিশ, সামরিক, বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার ওপর মনোযোগ দিতে বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে সংস্কার নিশ্চিত করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর ও জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে কারিগরি সহায়তা, পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন তৈরি সংক্রান্ত সহায়তা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক উদ্দেশে অপব্যবহার রোধের পাশাপাশি নিরাপত্তা বাহিনী যাতে পরবর্তী সরকারের দমনপীড়নের হাতিয়ার না হয়ে ওঠে, তা নিশ্চিত করতে র্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে।
গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর তাদের প্রতিবেদনে র্যাবকে বিলুপ্তির সুপারিশ করেছিল। র্যাবপ্রধান এ কে এম শহীদুর রহমান ইউনিটের গোপন আটক কেন্দ্রের কথা স্বীকার করে বলেছেন, যদি অন্তর্বর্তী সরকার ইউনিটটি বিলুপ্তি করে, তবে র্যাব তা মেনে নেবে। এই প্রেক্ষাপটে, এইচআরডব্লিউ জাতিসংঘ এবং দাতা সরকারকে সুপারিশ করেছে, র্যাব বিলুপ্তি হবে শুধু এই শর্তে যে, র্যাবের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের মানবাধিকার প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে, যাতে তারা অন্য ইউনিটে গিয়ে একই অপকর্মে লিপ্ত হতে না পারেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার আমলে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে এবং সেখান থেকে বের হয়ে তাদের সংস্কার করা কঠিন হবে।
কাঠামোগত সংস্কারের বিষয়ে এইচআরডব্লিউর জ্যেষ্ঠ গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। তাদের পদোন্নতি ও নিয়োগও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। তবে র্যাবকে সংস্কার করা সম্ভব না বলে মনে করেন তিনি।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাই-অভ্যুত্থানের সময়ে নজিরবিহীন মাত্রায় দমন-পীড়ন চালানো হয়েছিল, যা রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত নিরাপত্তা বাহিনীর একটি সুপ্রতিষ্ঠিত অনুশীলন। জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটি (সিএটি) ২০১৯ সালে বাংলাদেশ পুলিশের বাহিনীকে ‘রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র’ হিসেবে বর্ণনা করেছিল। পুলিশসহ বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়মুক্তি ও জবাবদিহি না থাকার বিষয়টিও সুপ্রতিষ্ঠিত।
প্রতিবেদনে টেকসই সংস্কারের সুপারিশের মধ্যে গণগ্রেপ্তার ও অজ্ঞাতনামা মামলার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ, আটক ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারকের সামনে হাজির করার ব্যবস্থা, রিমান্ডের প্রচলনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে, যেসব আইন জবাবদিহির পথে বাধা সৃষ্টি করে, সেগুলো সংশোধন বা বাতিল করার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।
এইচআরডব্লিউর জ্যেষ্ঠ গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার বলেন, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার মানবাধিকার ও বাক্স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলোতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু কর্তৃপক্ষের এই প্রতিশ্রুতির বিপরীত আচরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। ১৪০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। ১৬০ সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন বাতিল করা হয়েছে এবং অনেকের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। এ আইন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে আগের সরকার বাংলাদেশে ব্যবহার করেছিল।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
এইচআরডব্লিউ প্রতিবেদনটিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেরও (আইসিটি) সমালোচনা করা হয়েছে। কারণ, অতীতে এই আদালত অস্বচ্ছ বিচারব্যবস্থার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। আইসিটির অনেক ধারাই আন্তর্জাতিক মানের নয়, এখানে এখনও মৃত্যুদণ্ডের মতো বিধান রয়েছে। এ ছাড়া, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ধারাগুলো এখনও বিদ্যমান রয়েছে, যেমন অনুপস্থিতিতে বিচার করা। নভেম্বর পর্যন্ত এ আদালতে শেখ হাসিনাসহ ৮০ জনকে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে।