কৃষি ব্যাংক ও রাকাবের আর্থিক অবস্থার অবনতি

জিয়াদুল ইসলাম
২৬ জানুয়ারী ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
কৃষি ব্যাংক ও রাকাবের আর্থিক অবস্থার অবনতি

বিশেষায়িত খাতের বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) আর্থিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। মূলধন ঘাটতি, পুঞ্জীভূত লোকসান, খেলাপি ঋণের উচ্চ হার, তহবিল ব্যয় বৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে ব্যাংক দুটি। সম্প্রতি ব্যাংক দুটির জুনভিত্তিক আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিভিন্ন সূচকে এই অবনতির চিত্র উঠে আসে এতে। এ সময় শীর্ষ খেলাপি থেকে ঋণ আদায় জোরদার করাসহ বেশকিছু নির্দেশনা দেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। বৈঠকে এ দুই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডি উপস্থিত ছিলেন।

বিকেবি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালে। মূলত ফসল, মাছ ও প্রাণিসম্পদের উন্নয়নে ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে ২০১০ সাল-পরবর্তী সময় সে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পুরোদমে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে ব্যাংকটি; জড়িয়ে পড়ে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে। অন্যদিকে ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ভেঙে রাকাব প্রতিষ্ঠা করা হয়। কৃষি ব্যাংকের রাজশাহী বিভাগের শাখাগুলো নিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়। কৃষি ব্যাংকের মতো ২০১০ সাল-পরবর্তী সময় রাকাবেও ঋণ বিতরণে নানা অনিময় হয়। এসব ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানতও রাখা হয়নি। ফলে ঋণ আদায়ে তেমন সাফল্য আসছে না। জানা যায়, ব্যাংক দুটির পরিস্থিতি উন্নয়নে প্রতি বছর সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) আওতায় বিভিন্ন সূচকে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু বরাবরই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে তারা। এমন বাস্তবতায় গত বছরের এপ্রিলে ব্যাংক দুটি একীভূতকরণের কথা জানিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে শেষ পর্যন্ত সেই উদ্যোগও আলোর মুখ দেখেনি। এ বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য ব্যাংক দুটির এমডির মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তারা ধরেননি।

বাড়ছে তহবিল ব্যয় : বিকেবি ও রাকাবের তহবিল ব্যয় কমিয়ে আনার তাগিদ দিয়ে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ জন্য উচ্চ ব্যয়ের আমানত কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রাও বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু ব্যাংক দুটির উচ্চ ব্যয়ের আমানত আরও বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে তহবিল ব্যয়ও। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত ৫ হাজার ৬২১ কোটি টাকা উচ্চ ব্যয়ের আমানত কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল বিকেবির। এটি কমানো দূরে থাক, বরং আরও ৩ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা আমানত বাড়িয়েছে। অন্যদিকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির তহবিল ব্যয় ছিল ৮ দশমিক ১০ শতাংশ, যা গত বছরের জুনে বেড়ে হয় ৯ দশমিক ১৫ শতাংশ। আর রাকাবের ৬৯৬ কোটি টাকার উচ্চ ব্যয়ের আমানত কমানোর লক্ষ্য দেওয়া হয়। ব্যাংকটি এক টাকাও কমাতে পারেনি, বরং ১০৭ কোটি টাকার আমানত বেড়েছে। অন্যদিকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির তহবিল ব্যয় ছিল ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ, যা গত বছরের জুনে বেড়ে হয় ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

কমেনি খেলাপি ঋণ, আদায়েও ব্যর্থতা : গত জুন পর্যন্ত বিকেবির খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশে নামানোর লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়। এর বিপরীতে ওই সময় পর্যন্ত খেলাপি ঋণ রয়েছে ১২ দশমিক ৭২ শতাংশ, যার পরিমাণ ৪ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা। আর রাকাবের খেলাপি কমানোর লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া ছিল ১২ শতাংশ। এর বিপরীতে খেলাপি রয়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ, যার পরিমাণ ১ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। ব্যাংক দুটির শীর্ষ ২০ খেলাপি ও রাইট-অফ খেলাপি থেকে নগদ আদায়ের হারও সন্তোষজনক নয়। তথ্য অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত শীর্ষ ২০ খেলাপি থেকে বিকেবি ও রাকাবের যথাক্রমে ১৭৯ কোটি ও ৫০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। ব্যাংক দুটো মাত্র যথাক্রমে ২ কোটি ৬৬ লাখ ও ২৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা আদায় করতে পেরেছে। তবে অন্যান্য খেলাপি থেকে ( ছোট ও মাঝারি) থেকে আদায় পরিস্থিতি কিছুটা ভালো। বিকেবি এক হাজার ১২১ কোটি টাকার বিপরীতে ৬৮৭ কোটি এবং রাকাব ৪৫০ কোটি টাকার বিপরীতে ৪৩২ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে।

সিএমএসএমই ঋণ বিতরণের লক্ষ্য পূরণ হয়নি : গত অর্থবছরে বিকেবির মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (এমএসএমই) ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রার ৬১ শতাংশ বিতরণ করতে পেরেছে। রাকাবের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ব্যাংকটি ৯৭ শতাংশ বিতরণ করতে সক্ষম হয়েছে।

মূলধন ঘাটতি আরও বেড়েছে : দেশের ব্যাংক খাতে মূলধন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ব্যাসেল-৩ নীতিমালা অনুসরণ করা হয়। ওই নীতিমালা অনুযায়ী, বর্তমানে ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম চালানোর জন্য ন্যূনতম রক্ষিতব্য মূলধন (এমসিআর) ও ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফার (সিসিবি) থাকতে হবে তাদের মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ ও আড়াই শতাংশ হারে। কিন্তু এসব নিয়ম মেনে ব্যাংক দুটি মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না। উল্টো তাদের মূলধন ঘাটতি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সঙ্গে আরও অবনতি হয়েছে ঝুঁকিভিত্তিক মূলধন পর্যাপ্ততার হারেও (সিআরএআর)। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত রাকাবের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ২৩১ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের একই সময় যা ছিল ১৫ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা। আর রাকাবের জুন পর্যন্ত ঘাটতি দাঁড়ায় ২ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত এই ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা। অন্যদিকে, মূলধন পর্যাপ্ততার হারও ঋণাত্মক পর্যায়ে নেমেছে ব্যাংক দুটির। গত জুন পর্যন্ত হিসাবে বিকেবির সিআরএআর দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৫৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ। আর রাকাবের ঋণাত্মক হয়েছে ২৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

পুঞ্জীভূত লোকসান বেড়েছে একটির, আরেকটির প্রায় অপরিবর্তিত : রাকাবের ঋণ থেকে যে সুদ আয় হচ্ছে, তা দিয়ে আমানতকারীদের সুদ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। গত জুন পর্যন্ত সুদ খাতে লোকসান হয়েছে ৪৪৭ কোটি টাকা। এই সময়ে সুদ হিসেবে আয় হয়েছে ২ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা অথচ আমানতকারীদের সুদ হিসেবে দিতে হয়েছে ২ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা। নিট সুদ আয় নেতিবাচক হওয়ার কারণে পুঞ্জীভূত লোকসান বেড়েছে। জুন শেষে বিকেবির ১৬ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকার লোকসান দাঁড়িয়েছে। ২০২৩ সালের একই সময় ছিল ১৫ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে গত জুন পর্যন্ত রাকাবের নিট সুদ আয় হয়েছে ২৭১ কোটি টাকা। এতে ব্যাংকটির পুঞ্জীভূত লোকসান ২ হাজার ৬৯০ কোটি থেকে সামান্য কমে ২ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা হয়েছে।