ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনে বিশ্ব বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়বে

জাহাঙ্গীর সুর
২৫ জানুয়ারী ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনে বিশ্ব বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়বে

‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’, কিংবা ‘চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা’- এই দুটি প্রবাদের মূল হলো আত্মকেন্দ্রিকতা। ঘর বাঁচিয়ে তবেই পরকে নিয়ে ভাবা, ঠিক এ রকম আদর্শ প্রচার করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। দুই মেয়াদেই তিনি ভোটারের মন কেড়েছেন ‘মেইক আমেরিকা গ্রেইট এগেইন’ আদর্শ প্রচার করে। তার প্রথম মেয়াদ (২০১৭-২০২১) ছিল বাণিজ্যিক সুরক্ষা, কর কর্তন ও মার্কিন শিল্পকে উৎসাহিত করার দিকে যথেষ্ট মনোযোগী। এই নীতিগুলো তার দ্বিতীয় মেয়াদে আরও শক্তিশালী হতে পারে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে, যার বিশাল প্রভাব পড়তে পারে বিশ্ব অর্থনীতির ওপর। বিবিসি, রয়টার্স, দ্য গার্ডিয়ান ও সিএনএনের বিভিন্ন প্রতিবেদনের আলোকে এখানে কয়েকটি প্রধান দিক নিয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো।

বাণিজ্যিক সুরক্ষা ও বাণিজ্যযুদ্ধ : ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র তার বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক দেশ, বিশেষ করে চীন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির বিরুদ্ধে সুরক্ষা নীতি গ্রহণ করেছিল। তিনি ভিনদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেছিলেন। এর ফলে বাণিজ্যযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল।

ট্রাম্প এবারও চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক শুল্ক বাড়াতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ধারণা কী, তিনি শপথ নেওয়ার পরই বলেছেন, ১ ফেব্রুয়ারি থেকে চীনা পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ বাণিজ্য শুল্ক আরোপের কথা ভাবছে তার প্রশাসন। বিশেষ করে প্রযুক্তি ও উৎপাদন পণ্যের ক্ষেত্রে। এর ফলে চীন-মার্কিন বাণিজ্য সম্পর্কের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি হতে পারে, যা বিশ্ব বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

তবে এবার ট্রাম্পের বিকল্প ইচ্ছা হলো- চীনের সঙ্গে টেকসই বাণিজ্য চুক্তি করা। যেমনটি তিনি গত বৃহস্পতিবার ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘চীনের ওপর আমাদের একটি বড় শক্তি আছে, সেটি হলো শুল্ক। এটি তারা চায় না। আমিও চাই না আমাকে এগুলো ব্যবহার করতে হোক। কিন্তু চীন আমেরিকা থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে সামরিক বাহিনী গড়তে ব্যয় করছে।’

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে ফোনালাপের প্রসঙ্গ তুলে তার প্রশংসা করে ট্রাম্প বলেন, ‘শি আমার বন্ধুর মতো। সম্প্রতি তার সঙ্গে একটি সৌহার্দপূর্ণ ফোনালাপ হয়েছে। এটি একটি ভালো ও বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপ ছিল। আমরা বাণিজ্য চুক্তি করতেও পারি।’

তবে চুক্তি যদি না হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সুরক্ষা নীতির কারণে বাণিজ্যিক উত্তেজনা বাড়লে আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। বিভিন্ন দেশ তাদের নিজেদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনরায় যাচাই করতে পারে এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমতে পারে।

ডলার ও মুদ্রার মান : ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে মার্কিন ডলারের মান অনেকটাই অস্থির ছিল, বিশেষ করে তার বাণিজ্যিক নীতির কারণে। এবারও যদি ট্রাম্প আগের নীতির পুনরাবৃত্তি কিংবা আরও কট্টর নীতি গ্রহণ করেন, তাহলে ডলারে মান ওঠা-নামা করতে পারে এবং মুদ্রাযুদ্ধ বাধতে পারে।

ট্রাম্প প্রশাসন যদি অন্য একাধিক পরাশক্তির বিরুদ্ধে শুল্ক আরোপ করে, তাহলে হয়তো ডলার শক্তিশালী হতে পারে। কিন্তু একই সময় যদি বাণিজ্য সম্পর্কের সংকট গভীরতর হয়, সে ক্ষেত্রে ডলারের মান কিছুটা নিম্নমুখীও হতে পারে।

আবার ট্রাম্প যদি তার বাণিজ্যিক নীতিতে আরও আক্রমণাত্মক হন, তবে মুদ্রাযুদ্ধের সূত্রপাত হতে পারে। অন্যান্য দেশ তাদের মুদ্রার মূল্য কমাতে পারে, যাতে তারা আমদানিকৃত পণ্যের দাম কমাতে পারেন, যা বিশ্ব মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে।

কর সংস্কার : প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প কর কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, বিশেষ করে ব্যবসায়িক কর ও করপোরেট করের ক্ষেত্রে। দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম সপ্তাহেই তিনি করপোরেট কর হ্রাসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং এতে এরই মধ্যে মার্কিন পুঁজিবাজার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনে বৃহস্পতিবার ভিডিও কনফারেন্সে বক্তব্য দেওয়ার সময় ট্রাম্প স্বল্প সুদহারের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করা কোম্পানিগুলোর জন্য তিনি কর হ্রাস করবেন ও যারা বিনিয়োগ করবে না, তাদের শুল্ক বাড়াবেন। ট্রাম্পের এই নীতি মার্কিন ব্যবসায় ও ধনী শ্রেণির জন্য লাভজনক হতে পারে, বিশ্বে মার্কিন ব্যবসার প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে অন্যান্য দেশের করনীতি প্রভাবিত হবে।

এ ছাড়া ট্রাম্পের প্রশাসন দেশ-বিদেশে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে পারে, যা মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ইতিবাচক ও আশাব্যঞ্জক পরিবেশ সৃষ্টি করবে। মার্কিন স্টার্টআপ ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো আরও দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে, যা অন্য দেশগুলোর জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে।

ফলে দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্পের এবারের প্রশাসনও বিশ্ব অর্থনীতির কাছে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে। বিশ্বব্যাপী তার নীতি এমন হতে পারে যে, কিছু দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের রূপরেখা নতুন করে গড়তে পারে কিংবা অন্য পথ খুঁজতে চাইবে। ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতির কারণে কিছু দেশ তাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে চাইবে, যা বৈশ্বিক উৎপাদন ও সরবরাহ শৃঙ্খলকে প্রভাবিত করতে পারে।