ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী আল আমিনের দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু
ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী আল আমিনের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। কমিশনের উপ-সহকারী পরিচালক তাছলীমা আক্তার এক পত্রে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে আগামী ২৯ জানুয়ারির মধ্যে চাহিদা মোতাবেক কাগজপত্র দেওয়ার জন্য বলেছেন। গত ২০২৪ সালের ১৩ জুলাই এআমাদের সময -এ সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর এ পদক্ষেপ নিল দুর্নীতি দমন কমিশন।
গত ২১ জানুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশনের ঢাকা প্রধান কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক তাছলীমা আক্তার এ পত্র পাঠান।
ওয়াসার প্রধান কর্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আল-আমিনের ঢাকায় একাধিক জমি, ফ্লাট, গাজীপুরে রিসোর্ট, রাজবাড়ীর গ্রামের বাড়িতে আলিশান বাড়ি, গরুর খামার, বাড়িতে বিদেশি কুকুর, কবুতর, শত বিঘা জমিসহ অঢেল সম্পদ গড়ে তোলার অভিযোগ ওঠে।
এর আগে অবৈধ সম্পদ ও সম্পত্তি অনুসন্ধান ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে গত ৯ জুন দুর্নীতি দমন কমিশন ফরিদপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক ও ঢাকা প্রধান কার্যালয়ে পৃথক পৃথক অভিযোগ করেছেন বালিয়াকান্দি উপজেলার নারুয়া ইউনিয়নের খালিয়া গ্রামের আব্দুর রহমান ও বালিয়াকান্দি সদর ইউনিয়নের শালমারার রাকিবুল ইসলাম।
লিখিত অভিযোগে বলেন, রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি সদর ইউনিয়নের শালমারা গ্রামের মৃত শেখ মোয়াজ্জেমের ছেলে ঢাকা কাওরান বাজার ওয়াসা প্রধান কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আল আমিন। তার ঢাকা সাভারের একটি ৬ ছয় তলা বিল্ডিং, ঢাকা মোহাম্মদপুর বেঁড়িবাঁধে ১১ তলা বিল্ডিং, একটি ফ্ল্যাট, গাজীপুরে রিসোর্ট ও গ্রামের বাড়ি শালমারাতে ৭-৮ কোটি টাকা ব্যায়ে ৩তলা আধুনিক ডিজাইনের নির্মানাধীন ভবন, গরুর খামার, একাধিক অবৈধ স্থাপনা, বিভিন্ন ব্যাংক এ্যাকাউন্টে তার এবং তার পরিাবরের নামে অস্বাভাবিক ব্যাংক ব্যালেন্স রয়েছে।
এছাড়া বাড়িতে ছোট একটি ৩০ ফুটের টিনের ঘর এখনো রয়েছে। পাশের শরীকদের এক প্রকার জোড়পুর্বক সরিয়ে দিয়ে আলিশান বাড়ি তৈরি করছেন। গ্রামের বাড়িতে বিদেশি কুকুর, কবুতর ও গরুর খামার গড়ে তুলেছেন। মাঠে শত বিঘা জমি ক্রয় করেছেন। সরকারি খাল দখল করে বাড়িতে প্রবেশের রাস্তা নির্মাণ করেছেন। রাস্তা নির্মাণ করতে গিয়ে খালের পাশের কয়েকটি গাছ ফিল্মিস্টাইলে কেটেছে প্রকাশ্যে দিবালোকে। এ ঘটনায় নির্বাহী প্রকৌশলী আল আমিনের বিরুদ্ধে বালিয়াকান্দি থানায় একটি গাছ চুরি মামলা হয়। তিনি তার ও পরিবারের নামে থাকা অবৈধ সম্পত্তি সম্পর্কে অনুসন্ধান করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।
স্থানীয় বাসিন্দা অ্যাড. গোলাম মোস্তফা বলেন, প্রকৌশলী আল আমিন কয়েক বছর চাকরি করেই তার ভাগ্য খুলেছে। জানতে পেরেছি, ঢাকার মোহাম্মদপুরের বসিলায় ১০ শতাংশ জমির উপর ১২তলা ভবনে ২টি ফ্লাট, তার পাশেই বোনের নামে ৮ শতাংশ জমি, ২তলা ভবন, আশুলিয়ার জামগড়াতে জমি, হেমায়েতপুর, ফরিদপুরের এক বন্ধুর সাথে জমি, গাজীপুরের জয়দেবপুরে রিসোর্ট, গ্রামের বাড়িতে আলিশান বাড়ি নির্মাণ, মাঠে শত শত বিঘা জমি ক্রয়, গরুর খামার গড়ে তুলেছেন। সরকারি গাড়ি নিয়ে বাড়িতে আসে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে।
স্থানীয় ফ্রিজমিস্ত্রি টোকন বলেন, আল আমিনের বাড়ি আর তার বাড়ি একই। আল আমিন তার বাড়ির সৌন্দর্য্য করতে তাকে পাশেই বাড়ি করে দিয়েছেন। তার বাড়ি করতে খরচও দিয়েছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা মোক্তার হোসেন, জহির, ময়না, আঃ করিম বলেন, আল আমিনের বাবা ফায়ার সার্ভিসে চাকরি করতেন। কোনো রকম ভাবে সংসার চলতো। আল আমিন চাকরি পাওয়ার ৩-৪ বছরের মধ্যে বাড়িতে থাকা টিনের ঘরের সামনে আলিশান ৩ তলা ভবন নির্মাণ করছেন। বাড়িতে গরুর খামার, বিদেশি কুকুর, কবুতর পালন করেন। সরকারি খাল দখল করে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পথ তৈরি করেছেন। সরকারি গাড়ি নিয়ে বাড়িতে আসেন। মাঠে জমি পেলেই জমি ক্রয় করেন। এভাবে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। শুনেছি ঢাকায় একাধিক বাড়ি, ফ্লাটসহ বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে। মাত্র কিছু দিন চাকরি করে এতো সম্পদ কিভাবে গড়ে তুলেছেন। বাড়িতে আসেন সরকারি গাড়ি নিয়ে, চলেন রাজকীয় হালে। বিষয়টি খতিয়ে দেখে দুদককে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তিনি।
অভিযুক্ত আল আমিনের মা হোসনে আরা বেগম রুবি বলেন, বাড়ির যে ভবন করা হচ্ছে তার স্বামীর টাকায় করা। তিনি গরুর খামারসহ অন্যান্যভাবে প্রতি মাসে ২ লাখ টাকা আয় করেন। বাড়ির পথ নিয়ে বিরোধের কারণে তার ছেলের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করছেন। সব অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেন।
তিনি আরও বলেন, ছেলে মাঝে মাঝে সরকারি গাড়ি নিয়েই বাড়িতে আসেন। প্রতি বছর বিদেশে যায়। এবারও বিদেশে যাবে। এ কারণে বাড়িতে আসতে দেরি হবে।
ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী আল আমিন বলেন, তার গ্রামের বাড়িতে আনুমানিক ৭০ লাখ টাকা ব্যায়ের মাধ্যমে নির্মাণাধীন ৩ তলা ভবন, মোহাম্মদপুর বসিলায় দয়াল হাউজিংয়ে ১.০২ শতাংশ জমি, শালমারা, উত্তর শালমারা, শালকি ও সোনাইকুড়ি মৌজায় ২০.৭ লক্ষ টাকায় ৩.২ বিঘা ক্রয়কৃত কৃষি জমি রয়েছে। তার আয়কর নথিতে ঢাকার জমিসহ সকল সম্পদের বিবরণী অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ৭৯৯৪৯৪৮৬৮৫৭৯ নং আয়কর নথিতে ২০২৪ সালের ২৮ জানুয়ারি তথ্য অনুসারে ৮৪ লাখ ৭৫ হাজার ৭৫ টাকার স্থাবর অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। ওই নথি অনুযায়ী তিনি বাৎসরিক ৬ লাখ ৬৬ হাজার ৪০০ টাকা বেতন, ইন্টারেস্ট অন সিকিউরিটি ১ লাখ ৬৫ হাজার ৬০০ টাকা এবং কৃষি আয় ২ লাখ ৮০ হাজার টাকাসহ সর্বমোট ১১ লাখ ১২ হাজার টাকার আয়ের অনুকূলে ৬৬ হাজার ২৯১ টাকা আয়কর দিয়ে করে যাচ্ছেন। প্রকৌশলী আল আমিনের ঢাকা ওয়াসার প্রাতিষ্ঠানিক তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালের ৬ জুলাই অনুষ্ঠিত ঢাকা ওয়াসার অগ্রিম ঋণ সংক্রান্ত সুপারিশে পৈতৃক জমিতে গৃহনির্মাণ বাবদ ১ম কিস্তির ১০ লাখ টাকা ও স্মারক নং- ৪৬.১১৩.২০৮.০০.০১৩.০১৩.২০২০.৭৯৭ ২য় কিস্তিতে ৩০ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ করেন।
অন্যদিকে ২০২২ সালের ২২ মার্চ ব্র্যাক ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখা হতে ১২ লাখ টাকা ঋণ ও ইস্টার্ন ব্যাংক থেকে ৬ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণসহ পিতা হতে প্রাপ্ত পেনশন ও বাবার জীবন দশায় রেখে যাওয়া অর্থ সম্পদ থেকে ২০ লাখ টাকা গ্রহণ করে নির্মানাধীন বাড়ির কাজ করে যাচ্ছেন।
আল আমিন বলেন, তার বাবা শেখ মোয়াজ্জম হোসেন স্টেশন অফিসার হিসেবে ফায়ার সাভিস ও সিভিল ডিফেন্সে সুনামের সঙ্গে চাকরি করেন। পরে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তিনি পেনশনসহ জীবন দশায় ৩৫ লাখ টাকা রেখে যান আল আমিনের মায়ের নামে। তা থেকে তার মা নারী উদ্দোক্তা হিসেবে তিনি ২০২০ সালে খামার শুরু করেন। যা সরকার কর্তৃক নিবন্ধিত (নিবন্ধন নং ডিআর/রাজ/বালি ৩৩(২০২০-২১)।
প্রকৌশলী আল আমিন আরও বলেন, আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়েছে। গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে সামাজিকভাবে আমার সম্মানহানীর লক্ষ্যে দুদকে এ মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছে।