আব্বু বেঁচে থাকতে বড় পার্টি হতো
শুভ জন্মদিন নায়করাজ
৫৮ বছর আগে ১৯৬৬ সালে ‘১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন’ সিনেমায় ছোট্ট একটি চরিত্রে অভিনয় করে চলচ্চিত্র অভিনয়ে যার যাত্রা শুরু হয়, তিনি আর কেউ ননÑ নায়করাজ! জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ সিনেমায় অন্যতম প্রধান চরিত্রে অভিনয় করে চলচ্চিত্রে নিজের অবস্থান গড়ে নেন। এর পর থেকে টানা কয়েক দশক সিনেমার পর্দায় শাসন করেছেন। নায়করাজ রাজ্জাক বেঁচে থাকলে আজ ৮৩ বছর বয়সে পা দিতেন। ১৯৪২ সালের এই দিনে অবিভক্ত ভারতের কলকাতার কালীগঞ্জের নাকতলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। এই বিশেষ দিনে, তার জন্মদিন উপলক্ষে এফডিসিতে কোনো আয়োজন নেই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিল্পী সমিতি, প্রযোজক সমিতি, পরিচালক সমিতিসহ অন্য কোনো সংগঠন নায়করাজের জন্মদিন উপলক্ষে কোনো আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে না। তবে টিভি চ্যানেলগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে নায়করাজকে ঘিরে।
বাবার জন্মদিন প্রসঙ্গে নায়করাজ রাজ্জাকের ছোট ছেলে সম্রাট বলেন, ‘সত্যি বলতে কি, দিন যত যাচ্ছে, যে কারও জন্মদিন নিয়ে উচ্ছ্বাস কমে যাচ্ছে। একটা সময় আব্বুর জন্মদিনে বড় পার্টি হতো। সেই সময়টা খুব উপভোগ করতাম। কিন্তু এখন তো আসলে বিশেষ দিন বলেই যে এমন নয়, আব্বুর জন্য সব সময়ই দোয়া করি। আব্বুর কবরের কাছে যাই, আজকেও যাব। আল্লাহ যেন আমার আব্বুকে বেহেশত নসিব করেন। আব্বু কোনো দিন কাউকে কোনো কষ্ট দিয়ে থাকলে যেন ক্ষমা করে দেন। শুধু দোয়া চাই সবার কাছে। জন্মদিনে কেউ বিশেষ আয়োজন করলেন কী করলেন না, এসব নিয়ে আমাদের সত্যিই কোনো ভাবনা নেই।’ সম্রাট জানান, তার আব্বুর জন্মদিন উপলক্ষে এরই মধ্যে গরিব-এতিমদের খাওয়ানো হয়েছে। আজ বাসায় নিজেরাই দোয়া করবেন, কোরআন পড়বেন।
মাত্র আট বছর বয়সেই বাবা আকবর হোসেন ও মা নিসারুন্নেসাকে হারান। বাবা-মায়ের দেওয়া নাম ছিল আব্দুর রাজ্জাক। তবে তিন ভাই, তিন বোনের সংসারে বড়রা রাজ্জাককে বুঝতেই দেননি বাবা-মায়ের শূন্যতা।
রাজ্জাক যে পাড়ায় থাকতেন, সে পাড়ায়ই থাকতেন ছবি বিশ্বাস (কাঞ্চনজঙ্ঘা, জলসাঘরসহ অসংখ্য বাংলা ছবির শক্তিমান অভিনেতা), সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের মতো অভিনয়শিল্পীরা। ছবি বিশ্বাস বিপুল উৎসাহ নিয়ে আবৃত্তি শেখাতেন পাড়ার শিশু-কিশোরদের। রাজ্জাকও তার কাছে আবৃত্তি শিখেছেন। শিক্ষক রথীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী স্কুলেই একটি নারীবর্জিত নাটক করতে চাইলেন, নাম ‘বিদ্রোহী’। স্কুলের মেয়েরাও রাজ্জাকের অভিনয়ের তারিফ করল। তাতে অভিনয়ের প্রতি মনোযোগী হলেন।
আরও পড়ুন:
ওটিটি প্ল্যাটফরম আমার জন্য বেশ লাকি
রাজ্জাকের আইডল ছিলেন উত্তম কুমার। ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার পর রাজ্জাক ঠিক করলেন তিনি বোম্বে চলে যাবেন। পীযূষ বোস পরামর্শ দিলেন, ‘ক্যারিয়ার গড়তে হলে পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাও।’ মাইগ্রেশন করে খুলনা বর্ডার দিয়ে শিমুলিয়া হয়ে ঢাকায় চলে এলেন রাজ্জাক। তত দিনে তিনি বিয়ে করেছেন (১৯৬২)। স্ত্রী রাজলক্ষ্মী ও আট মাসের সন্তান বাপ্পারাজকে সঙ্গে করে ঢাকায় এলেন। শুরু হলো সংগ্রামী জীবন। ঢাকার কমলাপুরে ছোট্ট একটি বাড়িতে থাকতে শুরু করলেন। আয়-রোজগার নেই। যে টাকা এনেছিলেন, তা-ও ফুরিয়ে গেল।
অভিনয়ের সুযোগ সেভাবে হয়নি, পরিচালকের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। ‘কাগজের নৌকা’, ‘কাগজের বৌ’, ‘১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন’ ছবিতে ছোট চরিত্রে অভিনয় করলেন। ভালো চরিত্রের জন্য কেউ তখনও তাকে ডাকেনি। এরই মধ্যে দেখা হলো জহির রায়হানের সঙ্গে। গুণী এই নির্মাতা নিজের পরবর্তী ছবি ‘হাজার বছর ধরে’-এর নায়ক হিসেবে রাজ্জাককে নেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। তবে সে ছবি আর হয়নি। পরে ‘বেহুলা’ ছবির নায়কের চরিত্রে নিলেন রাজ্জাককে। পাঁচ হাজার টাকা পেয়েছিলেন ছবিটি করে। এরপর জহির রায়হানের ‘আগুন নিয়ে খেলা’ ছবি করে পেলেন সাত হাজার টাকা। রাজ্জাক পায়ের নিচে দাঁড়ানোর মতো মাটি পেলেন।
রাজ্জাক অভিনীত জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য একটি মাইলফলক। তিনি এরই মধ্যে ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘আবির্ভাব’, ‘এতটুকু আশা’, ‘কাঁচ কাটা হীরা’, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’ ইত্যাদি ছবি করে ফেলেছেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পরও রাজ্জাক ছিলেন খ্যাতির শিখরে। ‘ওরা ১১ জন’, ‘অবুঝ মন’, ‘রংবাজ’-এর মতো ছবি করেছেন। নারায়ণ ঘোষ পরিচালিত ‘আলোর মিছিল’ ছবিটি ছিল ব্যতিক্রমী। ‘অনন্ত প্রেম’ ছবিটির কথাও মানুষ অনেক দিন মনে রাখবে।
আরও পড়ুন:
ফের জুটি হলেন মম-শ্যামল
উল্লেখযোগ্য সিনেমার মধ্যে রয়েছে ‘কাগজের নৌকা’, ‘রংবাজ’, ‘আমার জন্মভূমি’, ‘স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা’, ‘স্লোগান’, ‘ঝড়ের পাখি’, ‘স্বরলিপি’, ‘আলোর মিছিল’, ‘বেঈমান’, ‘আবির্ভাব’, ‘মনের মতো বউ’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘দর্পচূর্ণ’, ‘যে আগুনে পুড়ি’, ‘টাকা আনা পাই’, ‘নাচের পুতুল’, ‘ওরা ১১ জন’, ‘অবুঝ মন’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘আনার কলি’, ‘রজনীগন্ধা’, ‘বড় ভালো লোক ছিলো’, ‘তওবা’, ‘চাপা ডাঙ্গার বউ’, ‘সন্ধি’।
অভিনয় ছাড়া পরিচালনাও করেছেন রাজ্জাক। তার প্রথম পরিচালিত ছবি ‘অনন্ত প্রেম’। দীর্ঘ অভিনয়জীবনে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মোট পাঁচবার শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেছেন। ২০১৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তাকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান থেকে মোট ছয়টি আজীবন সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেন তিনি। ২০১৫ সালে সংস্কৃতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।
আরও পড়ুন:
মারা গেলেন পরীমনির নানা