শীর্ষ পাচারকারীদের রক্ষায় ঘুষ নেন মাসুদ
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাসকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় গতকাল শনিবার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সহযোগিতায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাকে গ্রেপ্তার করে। দুদক সূত্রে জানা গেছে, অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল সম্পদ মালিক হওয়ার পাশাপাশি অর্থপাচার করেছেন বিএফআইইউর সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাস। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় তার একাধিক জমি ও ফ্ল্যাট রয়েছে। স্ত্রীর নামেও রয়েছে অনেক সম্পদ। পদে থাকাকালীন সময়ে শীর্ষ অর্থপাচারকারী, আর্থিক অনিয়মে জড়িত এবং অর্থপাচারের মামলা ধামাচাপা দিয়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেন তিনি। সেই অর্থ বিদেশেও পাচার করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রাথমিক গোয়েন্দা তথ্যানুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। পরে দুদক তার বিরুদ্ধে মামলা করে।
দুদকের মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলী বলেন, যে মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তা হলো অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা। সেখানে তিনি তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ প্রায় দুই কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন। এই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আরও অনেক অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য নেওয়ার জন্য আমরা তাকে ব্যাপকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করব।
দুদকের মহাপরিচালক বলেন, ওনার (মাসুদ বিশ্বাস) বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়েছে। ইতোমধ্যে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা পুরো বিষয়টি গভীরভাবে তদন্ত করবেন।
বিএফআইইউর এই সাবেক প্রধানের বিরুদ্ধে দুদকে আসা অভিযোগে বলা হয়, পদে থাকা অবস্থায় মাসুদ বিশ্বাস স্কাই ক্যাপিটাল এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজ কেনায় সন্দেহজনক অনিয়মের অভিযোগটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে না পাঠিয়ে ঘুষের বিনিময়ে এর ইতি টেনেছেন। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান তমাল পারভেজের ব্যাংক থেকে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা লুটপাটসহ আর্থিক অনিয়মের প্রতিবেদনকে গোয়েন্দা প্রতিবেদন হিসেবে না পাঠিয়ে ‘সাধারণ পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন’ হিসেবে পাঠানোর অনুমতি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অনিয়ম ও অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে শেয়ারবাজারের তালিকাভুক্ত হিমিদ্রী লিমিটেডের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করা হয়েছিল। মাসুদ বিশ্বাস ‘আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে’ তা প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
দুদক সূত্র জানিয়েছে, তানাকা গ্রুপ, এসএ গ্রুপ ও আনোয়ার গ্রুপের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত ‘নিশ্চিত তথ্য’ থাকা সত্ত্বেও অভিযোগগুলো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে না পাঠিয়ে মাসুদ বিশ্বাস ‘ব্যক্তিগত সুবিধা নেওয়ার মাধ্যমে’ নথিভুক্ত করেন। অর্থপাচারেরও আরও বেশকিছু অভিযোগ রয়েছে মাসুদ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলামের সঙ্গে যোগসাজশে ইসলামী ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ‘বিদেশে পাচার’, আবদুল কাদির মোল্লার থার্মেক্স গ্রুপ থেকে ‘অনৈতিক সুবিধা’ নিয়ে বিদেশে ‘অর্থপাচার’, জিনাত এন্টারপ্রাইজের অর্থ পাচারের মামলা ‘ঘুষের বিনিময়ে’ ধামাচাপা দিয়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদের সম্পদ অর্জন করেছেন তিনি। মাসুদ বিশ্বাসের অবৈধভাবে অর্জিত জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ রয়েছে বলে গোয়েন্দা তথ্যানুসন্ধানে গোপনে ‘সোর্স ইনফরমেশনের’ বরাতে প্রাথমিকভাবে সঠিক পরিলক্ষিত হওয়ায় গতবছরের ২৫ সেপ্টেম্বর মাসুদ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। কমিশনের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি দলকে এই অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর মাসুদ বিশ্বাসের বিদেশযাত্রা ঠেকাতে ৩ অক্টোবর পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চে চিঠি পাঠায় দুদক।
গত ২ জানুয়ারি ১ কোটি ৪৭ লাখ ৭২ হাজার ৬২২ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মাসুদ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
দুদক জানিয়েছে, মাসুদ বিশ্বাসের স্ত্রী কামরুন নাহারের নামে ৭২ লাখ ৫৬ হাজার ৯৯৯ টাকার ‘জ্ঞাত আয়বহির্ভূত’ সম্পদের তথ্য পাওয়ায় তার সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
জানা গেছে, গতকাল শনিবার ডিবি পুলিশের সহযোগিতায় মাসুদ বিশ্বাসকে রাজধানীর মিরপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে দুদক। পরে বেলা সোয়া ১২টার দিকে মাসুদ বিশ্বাসকে দুদক কার্যালয়ে নেওয়া হয়। এরপরে আদালতে নেওয়া হয়। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাসুমা রহমানের আদালত শুনানি শেষে মাসুদ বিশ্বাসকে দুদকের মামলায় কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ওমর ফারুক ফারুকী জানান, আদালতে মাসুদ বিশ্বাসের আইনজীবী কারাবিধি অনুযায়ী ডিভিশন ও চিকিৎসা সুবিধা চাইলে বিচারক তা নাকচ করে দেন।