ডেসকো-ডিপিডিসিতে আউট সোর্সিং নিয়োগ প্রথা বাতিলের দাবি

নিজস্ব প্রতিবেদক
১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ১৩:১৯
শেয়ার :
ডেসকো-ডিপিডিসিতে আউট সোর্সিং নিয়োগ প্রথা বাতিলের দাবি

রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ বিতরণ প্রতিষ্ঠান ডেসকো ও ডিপিডিসিতে আউট সোর্সিং বা ঠিকাদারের মাধ্যমে নিয়োগ প্রথা বাতিলের দাবি জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানগুলোতে আউট সোর্সিংয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত দুই সহস্রাধিক প্রকৌশলী ও বিদ্যুৎ কর্মী। একই সঙ্গে চাকরি জাতীয়করণ করে সরাসরি নিয়োগ দেওয়ারও দাবি জানিয়েছেন তারা।

প্রধান উপদেষ্টাকে দেয়া ওই স্মারকলিপিতে ভুক্তভোগীরা বলেছেন, ‘আউট সোর্সিং প্রক্রিয়ায় সেবাগ্রহণ নীতিমালা অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো জনবল সরবরাহ করে তাদের বেতনের বিপরীতে সরকারের কাছ থেকে নির্ধারিত হারে কমিশন নিলেও নিয়োগপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও কর্মীদের বেতন থেকে অবৈধভাবে অর্থ কেটে রাখছে কোম্পানিগুলো।এর ফলে বঞ্চনায় মানবেতর জীবন পার করছেন দুই সহস্রাধিক কর্মী।’

তাদের দাবি, তাদের চাকরি আউট সোর্সিং কোম্পানির কাছে বন্ধক না দিয়ে জাতীয়করণ করে সরাসরি ডেসকো ও ডিপিডিসিতে নিয়োগ দেওয়া হোক। বেতন বৈষম্য দূর করে শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে শতভাগ উৎসব ভাতা, প্রণোদনা, নববর্ষ ও বিভিন্ন সরকারি আদেশে জারিকৃত ভাতা প্রদান করা হোক। কর্তব্যরত অবস্থায় দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে পরিবারকে কমপক্ষে ৪০ লক্ষ টাকা এবং অঙ্গহানি হলে কমপক্ষে ২০ লক্ষ টাকা প্রদান করা হোক।

আউট সোর্সিং জনবলের পক্ষে ডেসকোতে কর্মরত প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন স্বাক্ষরিত স্মারকলিপিতে বলা হয়, ‘অলিখিত চুক্তি অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো আগ থেকেই নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মীদের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবের চেক বইয়ে স্বাক্ষর নিয়ে নিজেদের কাছে আটকে রাখেন। ফলে নিজেদের হিসাবে বেতনের টাকা ঢুকলেও তা তুলে নেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এরপর মৌখিক চুক্তি অনুযায়ী বেতন দেওয়া হয় আউট সোর্সিয়ে নিয়োগপ্রাপ্তদের।’ 

ভুক্তভোগীরা বলছেন, ‘আউট সোর্সিং প্রক্রিয়ায় সেবাগ্রহণ নীতিমালা অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো জনবল সরবরাহ করে তাদের বেতনের বিপরীতে সরকারের কাছ থেকে নির্ধারিত হারে কমিশন নিলেও নিয়োগপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও কর্মীদের বেতন থেকে অবৈধভাবে অর্থ কেটে রাখছে তারা। শুধু তাই নয় নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত পরিশ্রম করলেও মেলেনা ন্যায্য পারিশ্রমিক। অথচ আউট সোর্সিং প্রক্রিয়ায় সেবা গ্রহণ নীতিমালা ২০১৮ এর ৭ (১) ধারায়, অতিরিক্ত সময় সেবা প্রদান করলে চুক্তি অনুযায়ী অতিরিক্ত সেবা মূল্য প্রদানের কথা রয়েছে।’

ঠিকাদারের মাধ্যমে নিয়োগপ্রথা বাতিল করে কর্মক্ষেত্রে বৈষ্যম ও বঞ্চনার এই আধুনিক দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। 

ওই স্মারকলিপিতে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি ডেসকো ও ডিপিডিসিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লাইন অ্যান্ড ইকুয়েপমেন্ট মেইনটেনেন্স, মেইনটেনেন্স অব সাব স্টেশন অ্যান্ড সুইচিং স্টেশন, কমার্শিয়াল অপারেশন সাপোর্ট সার্ভিস এই তিন ক্যাটাগরিতে নিয়োগ দিয়ে থাকে। এসব ক্যাটাগরির অধীনে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার, সুপারভাইজার, ফোরম্যান, টেকনিশিয়ান, ইলেক্ট্রিশিয়ান, লাইনম্যান, সহকারী লাইনম্যান, মিটার রিডার, বিল সার্ভার ও হেলপার নিয়োগ দেওয়া হয়। যাদের মধ্যে এই মুহূর্তে ডেসকোতে কর্মরত আছেন ১৩৩৬ জন ও ডিপিডিসিতে কর্মরত আছেন ১০৭৬ জন। ঝড়, বৃষ্টি মহামারিসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে ঝুঁকিপূর্ণ সব দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করে যাচ্ছেন আউট সোর্সিংয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত এসব প্রকৌশলী ও কর্মীরা।

এমনকি বিদ্যুৎ বিল বিতরণ, নতুন সংযোগ-পুনঃ সংযোগ, মিটার বদলের মতো সরাসরি রাজস্ব আদায়ের কাজও সম্পন্ন হয় চুক্তিভিত্তিক এই কর্মীদের দিয়ে। আউটসোর্সিং হলেও বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থাপনার ঝুঁকিপূর্ণ সব কাজে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞদেরই নিয়োগ দেওয়া হয়।’

সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, ‘নিয়োগপ্রাপ্তদের কাজগুলো এতই বিপদজনক ও ঝুঁকিপূর্ণ যে, সামান্য ভুল ও অসতর্কতায় মুহূর্তেই নেমে আসতে পারে মৃত্যু, ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সমস্ত সিস্টেম। দীর্ঘদিন ধরে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে তিল তিল করে গড়ে ওঠা এসব জনবল আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে ডেসকো ও ডিপিডিসিতে নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্তরা অধিক দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও স্থায়ী জনবলের মতো বেতন-ভাতা কিংবা সুযোগ সুবিধা পান না তারা। করোনাকালেও পূর্ণ লকডাউন থাকা অবস্থায় সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে আউটসোর্সিং কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ২৪ ঘণ্টা মাঠপর্যায়ে কাজ করলেও কোন ধরনের ঝুঁকি ভাতা মেলেনি তাদের। অথচ ডেসকো-ডিপিডিসির কর্মকর্তাদেরকে এবং যারা কমপ্লেইন সেন্টারে, সাব স্টেশনে কর্মরত ছিলেন তাদের ঝুঁকিভাতা দেওয়া হয়। স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারি গ্রেডে বেতন, প্রফিট বোনাস, উৎসব বোনাস, চিত্তবিনোদন ভাতা, ইনসেনটিভ বোনাস, পোশাক ভাতা, সন্তানদের জন্য চিকিৎসা ভাতা, বৈশাখী ভাতা, ইনক্রিমেন্ট ও সব ধরনের ছুটিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা পেলেও আউট সোর্সিং কর্মচারীদের তা কখনোই মেলে না।’

সংশ্লিষ্টরা আরও যোগ করেন, ‘শুধু বেতন-ভাতার বৈষম্য নয় কর্মজীবনে কখনো ছুটিও পান না আউট সোর্সিংয়ে নিয়োগপ্রাপ্তরা। কোনো সহকর্মীর ছুটির প্রয়োজন হলে বদলি দায়িত্ব পালন করতে হয় অন্য সহকর্মীদের। চাকরি প্রত্যাশীদের আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় নিয়োগের সময়ও নেওয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা। প্রতি দুই তিন বছর পর পর নিয়োগ নবায়নেও ঘুষ দিতে হয় ঠিকাদারসহ সংশ্লিষ্টদের।’

এদিকে ভুক্তভোগীরা বলছেন, ‘ডেসকো থেকে একজন সিনিয়র প্রকৌশলীর ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে প্রতিমাসে বেতন বাবদ ৫৬ হাজার টাকা দেয়া হলেও বাস্তবে তার পকেটে যায় মাত্র ৪২ হাজার টাকা, একজন জুনিয়র প্রকৌশলীর হিসাবে ৪১ হাজার ৫০০ টাকা দেওয়া হলেও বাস্তবে তিনি পান ৩০ হাজার টাকা, একজন ফোরম্যানের বেতন ২২ হাজার ধরা হলেও বাস্তবে তিনি পান ১৫ হাজার, লাইনম্যানের বেতন ২০ হাজার হলেও বাস্তবে মেলে ১২ হাজার, সহকারী লাইনম্যানের বেতন ১৬ হাজার হলেও বাস্তবে পান ১০ হাজার টাকা।

আবার ডিপিডিসিতে একজন সিনিয়র ফোরম্যানের (গ্রেড-১) ৩৪ হাজার ৫০০ টাকা বেতন হলেও বাস্তবে তিনি পান ২৪ হাজার টাকা। জুনিয়র ফোরম্যান ৩১ হাজার ৫০০ টাকা পেলেও ঠিকাদার দেন মাত্র ২২ হাজার টাকা। লাইনম্যানের বেতন বাবদ ডেসকো থেকে ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হলেও ঠিকাদার দেন ১৮হাজার টাকা, সহকারী লাইনম্যানের বেতন ২০ হাজার হলেও বাস্তবে পকেটে যায় ১৪ হাজার টাকা, হেলপারের বেতন বাবদ ১৬ হাজার টাকা দেওয়া হলেও বাস্তবে তারা পান মাত্র ১২ হাজার টাকা। আউট সোর্সিংয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত এসব কর্মীদের টাকা অবৈধভাবে কেটে রেখে বছরের পর বছর ধরে নিজেদের পকেট ভারী করছে ঠিাকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। যেসব প্রতিষ্ঠানের সবগুলোই মূলত পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আশীর্বাদপুষ্টদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।’ 

ভুক্তভোগীরা আরও বলছেন, ‘ডেসকো-ডিপিডিসির এই আউট সোর্সিং নিয়োগ প্রথা মূলত আধুনিক দাসপ্রথার অত্যাধুনিক সংস্করণ। পতিত আওয়ামী দোসরদের টাকা বানানোর মেশিন। শ্রমিক ঠকিয়ে যার মাধ্যমে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে আত্মসাত করে এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।’ 

এদিকে আউট সোর্সিং কর্মীরা বলছেন, ‘সরকার বেতন বাবদ অর্থ পরিশোধ করলেও তা সাধারণ প্রকৌশলী ও বিদ্যুৎ কর্মীরা ন্যায্যভাবে পাচ্ছেন না। মাঝখান থেকে আউট সোর্সিং জনবল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পকেট ভারী হচ্ছে। আর বঞ্চনায় মানবেতর জীবন পার করছেন দুই সহস্রাধিক কর্মী।’